আজ ৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

সময় : সকাল ৯:৫৫

বার : শুক্রবার

ঋতু : গ্রীষ্মকাল

সুদহার বাড়তে পারে, কমবে কি মূল্যস্ফীতি?

সুদহার বাড়তে পারে, কমবে কি মূল্যস্ফীতি?

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে গিয়ে পরপর তিন বার রেপোর সুদহার বাড়ানো হয়েছে, কিন্তু মূল্যস্ফীতির পারদ নিম্মমুখী হয়নি। শুধু তাই নয়, বাজারে মুদ্রা সরবরাহও কমেনি। উপরন্তু, ঋণ প্রবাহ বেড়েই চলেছে বেসরকারি খাতে। এর ফলে গত বছরের তুলনায় এবার প্রত্যেকটি পণ্যের দাম বেড়ে গেছে।

সরকারি হিসাবেই গত সেপ্টেম্বর মাসে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ১০ শতাংশ। অর্থাৎ গত বছরের সেপ্টেম্বরে যে পণ্য বা সেবা ১০০ টাকায় পাওয়া যেতো, সেই পণ্য বা সেবা পেতে এখন ১০৯ টাকা ১০ পয়সা খরচ করতে হচ্ছে। তবে ভোক্তাদের বাস্তবে খরচ বেড়েছে আরও বেশি।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও (আইএমএফ) ব্যাংক ঋণের সুদহারের বেঁধে দেওয়া সীমা তুলে দেওয়ার সুপারিশ করেছে। এছাড়া ব্যাংক কর্মকর্তারাও বলছেন, ডলারের দাম ও মূল্যস্ফীতি বেড়ে অর্থনীতিতে এখন যে চাপ তৈরি হয়েছে, তাতে নির্দিষ্ট সুদহারে থাকা ব্যাংকগুলোর পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছে।

এমন পরিস্থিতিতে আমানত ও ঋণের সুদহারের সীমা তুলে দেওয়া অথবা সুদহার বাড়ানোর বিষয়ে গুরুত্ব দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বুধবার (১২ অক্টোবর) রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকের এমডিদের সঙ্গে এ সংক্রান্ত বৈঠক হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকে। বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু ফারাহ মো. নাছেরের সভাপতিত্বে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আফজাল করিম, অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং সিইও মো. মুরশেদুল কবির, রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং সিইও মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর ও জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুস সালাম আজাদ উপস্থিত ছিলেন।

বৈঠকে উপস্থিত একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির চাপ তৈরি হয়েছে ব্যাংক খাতে। ব্যাংকগুলোর আমানতসহ সব কিছুতে খরচ বেড়েছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি সুদ বা রেপো রেট বাড়ানো হয়েছে, আন্তব্যাংক রেট বেড়েছে। ডলারের রেট বেড়েছে। কিন্তু ঋণের সুদ হার বাড়ছে না। এর ফলে ব্যাংকগুলো নানা ধরনের সমস্যায় পড়েছে। যে কারণে ঋণের সুদহার বাড়ানোর বিষয়টি এখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তবে গভর্নর দেশের বাইরে থাকায় কোনও নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়নি।

অবশ্য কিছুদিন আগেও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেছিলেন— সুদহার সীমা তুলে দিলে উদ্যোক্তাদের খরচ আরও বাড়বে।

পাশাপাশি ব্যাংকেরও তহবিল ব্যবস্থাপনা খরচ বৃদ্ধি পাবে। আমরা উদ্যোক্তাদের কম খরচে ঋণ দিতে চাই। যাতে উৎপাদন খরচ কমে আসে।

যদিও দেশের ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির মধ্যে ঋণের সুদহার না বাড়ানোর কারণেই মূল্যস্ফীতি আরও সক্রিয় হচ্ছে। এ বিষয়ে ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদরা ঋণের সুদহার বাড়ানোর বিষয়ে বারবার পরামর্শ দিলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক তা আমলে নেয়নি। এখন মূল্যস্ফীতি অতিমাত্রায় বৃদ্ধির কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদহার বাড়ানোর বিষয়ে পর্যালোচনা করতে ব্যাংকগুলোর সঙ্গে বসছে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন,  ‘অর্থনীতির ওপর এখন যেভাবে চাপ তৈরি হয়েছে, এমন পরিস্থিতিতে সুদহার বেঁধে রাখা ঠিক হচ্ছে না। এছাড়া ব্যাংকে আগের মতো উদ্বৃত্ত অর্থও নেই। কারণ, মানুষ আমানত তুলে নিচ্ছে। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে অনেকেই সঞ্চয় কমাচ্ছে। আবার ব্যাংকগুলোকেও নিয়মিত ডলারও কিনতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলোকে বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। সুদহার বাড়িয়ে আমানত সংগ্রহ করতে হবে। একইভাবে ঋণের সুদহারও বাড়াতে দিতে হবে।’

ব্যাংকাররা বলছেন, আমানতে টান পড়ায় ঋণের সুদহার বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা তৈরি হয়েছে ব্যাংকগুলোর। কিন্তু সীমা বেঁধে দেওয়ায় ঋণের সুদ বাড়াতে পারছে না। এতে হয় খরচ কমাতে হবে না হয় সুদ বাড়াতে হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো এখন কর্মীদের বেতন কমানো ও জনবলে খরচ কমানোর সুযোগ নেই।

গত বছরের ৮ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংক আমানতকারীদের স্বার্থে তিন মাস ও এর বেশি মেয়াদের আমানতে সুদের হার মূল্যস্ফীতির হারের চেয়ে কম হতে পারবে না বলে নির্দেশনা দিয়েছিল। বর্তমানে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ১০ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই নির্দেশনার ফলে ব্যাংকগুলোকে ৯ দশমিক ১০ শতাংশের বেশি হারের সুদে আমানত সংগ্রহ করতে হচ্ছে। কিন্তু ঋণ ব্যাংকগুলোকে বিতরণ করতে হচ্ছে ৯ শতাংশের কম সুদে। সুদ বা মুনাফা নির্ধারণে আগের তিন মাসের গড় মূল্যস্ফীতি হারকে বিবেচনায় নিতেও ব্যাংকগুলোকে  বলা হয়েছে।  কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই নির্দেশনায় বলা হয়, ব্যক্তি পর্যায়ের মেয়াদি আমানত এবং বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকতা-কর্মচারীদের প্রভিডেন্ট ফান্ড, অবসরোত্তর পাওনাসহ বিবিধ পাওনা পরিশোধের লক্ষ্যে গঠিত তহবিল বাবদ রক্ষিত যেকোনও পরিমাণ মেয়াদি আমানতের ওপর সুদ বা মুনাফা হার মূল্যস্ফীতি হার অপেক্ষা কোনোক্রমেই কম নির্ধারণ করা যাবে না।

প্রসঙ্গত, কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমানতের সুদহার নির্ধারণ যখন করে দেয়, তখন ঋণের সুদহার ছিল ৯% আর মূল্যস্ফীতি ছিল ৫.৬৪%।  অথচ গত সেপ্টেম্বরে দেশের মূল্যস্ফীতি ৯.১ শতাংশ ছাড়িয়েছে। কিন্তু ব্যাংক ঋণের সুদহার একই রয়ে গেছে। তাই সুদহার বাড়ানোর বিষয়ে পূর্ব পর্যালোচনা হিসেবে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর সঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে।

এদিকে মূল্যস্ফীতির চাপ সামলাতে চার মাসের মধ্যে তিন বার নীতি সুদহার বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। যদিও অনেকেই বলছেন, ব্যাংক ঋণের সুদহার না বাড়িয়ে তা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কোনও উপকারে আসছে না।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ঋণের সুদহার বাড়লেই কেবল বাজারে মুদ্রা সরবরাহ কমাতে ভূমিকা রাখবে, যা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখবে। কেননা, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বোচ্চ সীমা বহাল থাকার নির্দেশনায় রেপোর কারণে ব্যাংকের অর্থ ধার নেওয়ার খরচ বাড়লেও ঋণ পেতে সুদহার ৯ শতাংশের বেশি লাগছে না। ফলে ঋণ বিতরণ বেড়েছে। অপরদিকে আমানতে সুদ হার বাড়াতে না পারায় চাহিদা অনুযায়ী আমানত আসছে না। এতে কমে আসছে ব্যাংকের উদ্বৃত্ত তারল্য। গত আগস্ট শেষে ব্যাংক খাতে উদ্বৃত্ত তারল্য ১ লাখ ৭৪ হাজার ১৭৭ কোটি টাকায় নেমেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন শেষে ব্যাংক খাতে উদ্বৃত্ত তারল্য ছিল ২ লাখ ৩ হাজার ৪২৪ কোটি টাকা। গত জুলাইয়ে ১ লাখ ৮৮ হাজার ৭২৫ কোটি টাকায় নামে। আগস্টে কমেছে আরও ১৪ হাজার কোটি টাকা। গত বছরের আগস্ট শেষে ব্যাংক খাতে উদ্বৃত্ত তারল্য ছিল ২ লাখ ৩১ হাজার কোটি টাকার বেশি।

মূলত, সরকারের পরামর্শে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২০ সালের এপ্রিলে সুদহারে ‘নয়-ছয়’ সীমা বেঁধে দেয়। ৯ শতাংশের বেশি সুদে ঋণ দেওয়া যাবে না বলে বাধ্যবাধকতা আরোপ করে, যা এখনও বহাল আছে। কিন্তু অস্বাভাবিক মূল্যস্ফীতির কারণে বেঁধে দেওয়া সুদহারে ‘নয়-ছয়’ সীমা ঠিক রাখা যাচ্ছে না।

এ প্রসঙ্গে বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট জাহিদ হোসেন বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য রেপো রেট বাড়ানো হলেও এতে শুধু কলমানি মার্কেটে সুদহার সাড়ে ৫ শতাংশ থেকে আরেকটু বাড়বে। এছাড়া আর কোনও প্রভাব পড়বে না।’ তার মতে,  বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণে ৯ শতাংশ সুদহার নির্ধারণ করে দিয়েছে। এখানে কোনও পরিবর্তন আনেনি। এটি বাড়ালে বা কিছুটা শিথিল করে অর্থাৎ ৯ থেকে সর্বোচ্চ ১২ বা ১৫ শতাংশ করলে ব্যবসায়ীদের ঋণের খরচ বাড়তো। তখন তারা ব্যয় নিয়ন্ত্রণে যেতো। মূল্যস্ফীতিও নিয়ন্ত্রণে থাকতো।

সাধারণত, এক থেকে ২৮ দিনের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোর টাকা ধার করার নামই হচ্ছে রেপো। এর মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারে তারল্য ও বিনিয়োগ নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে। রেপো সুদহার হিসেবে পরিচিত নীতি সুদহার বাড়ানোর অর্থ হলো— কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অর্থ ধার করতে এখন বাড়তি সুদ দিতে হবে ব্যাংকগুলোকে।

অন্যান্য দেশকে অনুসরণ করে বাংলাদেশ ব্যাংকও মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে দুই বছর পর গত ২৯ মে প্রথম রেপো সুদহার ৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫ শতাংশে উন্নীত করে। এরপর চার মাসের মধ্যে গত ২৯ সেপ্টেম্বর তৃতীয়বার আরও ২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে রেপো হার ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ নিয়ে যায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে মূলত টাকার প্রবাহ কমাতে। যাতে ব্যাংকগুলো বেশি সুদের কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কম টাকা ধার করে— এটি নিশ্চিত করতেই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে ব্যাংক ঋণের সুদহার না কমানোর কারণে টাকার ফ্লো কমছে না।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত আগস্টে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৪.০৭%। যা গত প্রায় চার বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।

এদিকে সরকারি হিসাবে গত সেপ্টেম্বর মাসে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ১০ শতাংশ। আগের মাস আগস্টের তথ্য ছিল আরও ভয়াবহ। ওই মাসে মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ।

এ প্রসঙ্গে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ‘উচ্চবিত্ত বা উচ্চ মধ্যবিত্ত ছাড়া সব মানুষই এখন মূল্যস্ফীতির ভয়ানক কষ্টে আছেন। এই কষ্ট থেকে ক্ষোভ-হতাশা বাড়ছে। বিশেষ করে যারা নির্দিষ্ট আয়ের তারা সবচেয়ে বেশি সংকটে রয়েছেন।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     More News Of This Category