আজ ১২ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৫শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

সময় : সকাল ১১:৪৭

বার : বৃহস্পতিবার

ঋতু : গ্রীষ্মকাল

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন কমেছে বিদেশি শিক্ষার্থী?

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন কমেছে বিদেশি শিক্ষার্থী?

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির সংখ্যা দিন দিন কমছে। গত পাঁচ বছরে ভর্তির নিম্নমুখী ধারা অব্যাহত ছিল। চলতি শিক্ষাবর্ষে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির সংখ্যা শূন্যের কোঠায় দাঁড়িয়েছে। কারণ হিসেবে ইংরেজিতে পাঠদান না করা, সেশনজট, আন্তর্জাতিক মানের পাঠ্যক্রমের অনুপস্থিতি, বই-নোটসহ বেশির ভাগ শিক্ষা উপকরণ বাংলা ভাষায় হওয়াকে দায়ী করেছেন তারা। এ ছাড়া ডরমিটরির শিক্ষার পরিবেশ নিয়েও অভিযোগ আছে তাদের।

রাবির শিক্ষকরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক র‌্যাঙ্কিংয়ে বিদেশি শিক্ষার্থীর অনুপাত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উচিত শিক্ষার্থীদের অনাগ্রহের কারণ খুঁজে বেরা করা। প্রয়োজনে বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো দরকার।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমির শাখা সূত্রে জানা যায়, প্রথম ২০১৪-১৫ সেশনে মাত্র দুজন নেপালি শিক্ষার্থী ভর্তির মাধ্যমে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক পর্যায়ে বিদেশি শিক্ষার্থীর আগমন শুরু হয়। এর আগে বিদেশি কোনও শিক্ষার্থী ভর্তির তথ্য নেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের হাতে। পরের বছর ২০১৫-১৬ সেশনে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় তিনে। ২০১৭ সালে জর্ডান, সোমালিয়া ও নেপাল থেকে ভর্তি হন ১০ শিক্ষার্থী। ২০১৮ সালে নেপাল ও জর্ডান থেকে আট শিক্ষার্থী ভর্তি হন। তবে সময়ের ব্যবধানে মাত্র একজন ছাড়া কোর্স শেষ করেননি কেউ। ২০১৯ সালের ৯ জানুয়ারি একসঙ্গে পাঁচ জন নেপালি শিক্ষার্থী কোর্স শেষ না করে বাংলাদেশ ত্যাগ করেছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ভর্তি হয়ে ২০১৯ সালে বছর না পেরোতেই চলে যান জর্ডানের শিক্ষার্থী রাদ ইব্রাহিম খলিল আবুশায়ুন। এরপর ২০১৯-২০ সেশনে চার জন বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হলেও ২০২০-২১ সেশনে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির ধারাবাহিকতায় ভাটা পড়ে। ওই বছর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলা থেকে অন্তরা হালদার নামে এক শিক্ষার্থী ভর্তি হন। ২০২২ সালে ভারত থেকে এক শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য আবেদন করলেও পরে ভর্তি হতে অনাগ্রহ প্রকাশ করেন।

রাবিতে অধ্যয়নরত কমপক্ষে চার বিদেশি শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তাদের অভিযোগ, বাংলা মিডিয়ামে পাঠদান কার্যক্রম পরিচালনা করলেও বিদেশি শিক্ষার্থীদের আলাদাভাবে বাংলা ভাষা শেখানো হয় না। এ ছাড়া এখানে বিভাগগুলো চার বছর ও এক বছর মেয়াদি। কোর্সগুলো নির্ধারিত সময়ে শেষ হয় না। এতে তারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এ ছাড়া আবাসিক হলে শিক্ষার পরিবেশ নেই। ফলে তারা অন্যদের এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে নিরুৎসাহিত করেন।

নেপাল থেকে আসা ২০১৭-১৮ সেশনের ভেটেরিনারি সায়েন্সস অ্যান্ড অ্যানিমেল বিভাগের শিক্ষার্থী সনি কুমার দাস বলেন, ‘আমাদের অ্যাপ্লিকেশনের সময় বলা হয়ে থাকে, পড়াশোনার মাধ্যমে হবে ইংরেজি। কিন্তু আমরা এখানে এসে দেখি, আমাদের ক্লাস লেকচারগুলো বাংলাতে হচ্ছে।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমি চার বছরের কোর্স করার জন্য এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছি। কিন্তু চার বছর শেষ হলেও এখনও কোর্স শেষ হয়নি। আমি যে বৃত্তি পেতাম, সেটিও চার বছর পর বন্ধ হয়ে গেছে। এ অবস্থায় আমাকে ঋণ করে পড়াশোনা চালাতে হচ্ছে। এ ছাড়া ডরমিটরিতেও পড়াশোনার ভালো পরিবেশ নেই।’

ডরমিটরির বাসিন্দা এম.ফিল গবেষক আব্দুল মজিদ অন্তর বলেন, ‘আমাদের ডরমেটরিটি শুধু নামে আন্তর্জাতিক, বাস্তবে এখানে আন্তর্জাতিক মানের কোনও উপাদানই নেই। নেই কোনও কম্পিউটার ল্যাব। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের জন্য ইন্টারনেট সুবিধা পর্যন্ত নেই। নিজেদের খরচে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে হয়। এ ছাড়া আসবাবপত্রগুলো আন্তর্জাতিকমানের নয়। বিষয়গুলো নিয়ে আমরা একাধিকার ওয়ার্ডেনের সঙ্গে কথা বলেছি। কিন্তু সমাধান হয়নি।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে শহীদ মীর আব্দুল কাইয়ূম ইন্টারন্যাশনাল ডরমিটরির ওয়ার্ডেন (তত্ত্বাবধায়ক) অধ্যাপক আতাউর রহমান রাজু বলেন, ‘করোনার কারণে বিশ্বব্যাপী শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক রয়েছে। ফলে শিক্ষার্থীরা বাইরের দেশে যাচ্ছে না। এ ছাড়া আমাদের এখানে বাংলা মিডিয়ামে পাঠদান কার্যক্রমের কারণে বাইরের শিক্ষার্থীরা সমস্যার সম্মুখীন হয়। তবে ডরমিটরির পরিবেশ পুরোপুরি আন্তর্জাতিক মানের না হলেও আমরা চেষ্টা করছি ছাত্রদের সর্বোচ্চ সুযোগ সুবিধা দিতে।’

বিদেশি শিক্ষার্থী ছাড়া একটি বিশ্ববিদ্যালয় কখনোই তার সর্বজনীনতা ধরে রাখতে পারে না উল্লেখ করে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সালেহ হাসান নকিব বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণাটা আন্তর্জাতিক। এমনকি আমেরিকান অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থানীয় শিক্ষার্থীর চেয়ে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী বেশি। আমাদের বিদেশি শিক্ষার্থীর দরকার অনেক বেশি। যদি একটি দেশের বা এলাকার শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করে, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়টি সর্বজনীন চেহারা ধারণ করতে পারে না। আন্তর্জাতিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাঙ্কিংয়ের ক্ষেত্রে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাতের পাশাপাশি বিদেশি শিক্ষার্থীর অনুপাতও গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয়।’

তবে বাংলাদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির সময় শিক্ষার্থীদের মান বিবেচনায় রাখার ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশ থেকে যেসব শিক্ষার্থী বিদেশে পড়তে যায়, তারা মোটামুটি সবাই-ই ক্লাসের ভালো শিক্ষার্থী। আমাদের বিদেশি শিক্ষার্থী দরকার কিন্তু ভর্তির সময় শিক্ষার্থীর মান বিবেচনা করার প্রয়োজন আছে।’

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য অধ্যাপক মো. সুলতান-উল-ইসলাম বলেন, ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থীর মধ্যে অধিকাংশই সোমালিয়ান। তারা বাংলা বুঝতে পারে না। এ ছাড়া ইংরেজিতেও দুর্বল। আবার আমাদের শিক্ষকরাও বাংলায় ক্লাস লেকচার দেন। ফলে শিক্ষার্থীদের এখানে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। এ ছাড়া  আমাদের ডরমিটরিতেও কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। তবে আমরা এসব সমস্যা সমাধানে কাজ করছি।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     More News Of This Category