টানা ১৪ মাসের রক্তক্ষয়ী সংঘাতের পর লেবাননের সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহ ও ইসরায়েলের মধ্যে ৬০ দিনের যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। ২৬ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সের মধ্যস্থতায় হওয়া এই চুক্তি আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধের তীব্রতা কমানোর একটি প্রচেষ্টা। তবে এই যুদ্ধবিরতি মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নতুন দিক উন্মোচন করবে, নাকি আরও জটিলতা সৃষ্টি করবে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে।
চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, ইসরায়েল দক্ষিণ লেবানন থেকে সেনা প্রত্যাহার করবে এবং হিজবুল্লাহ লাতিনি নদীর উত্তর থেকে নিজেদের যোদ্ধাদের সরিয়ে নেবে। যুদ্ধবিরতির মেয়াদে কোনো পক্ষ একে অপরের ওপর হামলা চালাতে পারবে না। তবে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পরদিনই লেবাননের ভেতরে ইসরায়েলের হামলার খবর পাওয়া গেছে।
যুদ্ধবিরতির পর দক্ষিণ লেবাননে লেবাননের সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষীরা সেখানে অস্ত্রবিহীন অবস্থায় থাকবেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এ চুক্তিকে স্বাগত জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
এই সংঘাতে ইসরায়েলি হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন হিজবুল্লাহর প্রধান হাসান নাসরুল্লাহসহ শীর্ষ নেতারা। ১৪ মাসের যুদ্ধে ৩,৮০০ লেবানিজ নিহত এবং ১৬ হাজারেরও বেশি আহত হয়েছেন। বাস্তুচ্যুত হয়েছেন ১২ লাখ মানুষ। ধ্বংস হয়েছে প্রায় এক লাখ স্থাপনা।
অন্যদিকে, হিজবুল্লাহর একের পর এক হামলায় উত্তর ইসরায়েল থেকে ৬০ হাজার ইসরায়েলি তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন। হিজবুল্লাহর ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চল ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
লেবাননের জন্য এ যুদ্ধবিরতির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব অত্যন্ত গভীর। সংঘাত শুরুর আগেই লেবানন ভঙ্গুর অর্থনীতি, অবকাঠামোগত দুর্বলতা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতায় জর্জরিত ছিল। সংঘাত এই সংকটকে আরও প্রকট করেছে।
লেবাননের রাজনৈতিক অঙ্গনেও সংঘাতের পর নতুন অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। দুই বছর ধরে দেশটিতে কোনো প্রেসিডেন্ট নেই। হিজবুল্লাহর মিত্রদের মধ্য থেকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দাবি রাজনৈতিক জটিলতা বাড়িয়েছে।
অন্যদিকে, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যুদ্ধবিরতিকে নিজেদের বিজয় হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি দাবি করেন, ‘হিজবুল্লাহকে এক দশক পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে।’ তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই দাবির অনেকাংশই বাগাড়ম্বর।
ইসরায়েলি হামলায় হিজবুল্লাহ দুর্বল হলেও সংগঠনটির ধ্বংস অসম্ভব বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। হাসান নাসরুল্লাহর শাহাদাত তাকে প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। স্কটল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব স্টারলিংয়ের শিক্ষক বশির সাদির মতে, নাসরুল্লাহ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের স্থায়ী প্রতীক হয়ে উঠবেন।
তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, হিজবুল্লাহ দুর্বল হওয়ার ফলে লেবাননের অভ্যন্তরে ক্ষমতার লড়াই শুরু হতে পারে। এই পরিস্থিতি দেশটিকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে পারে, যা লেবাননের জন্য একটি ভয়াবহ সংকট ডেকে আনবে।
‘ইরানের প্রতিরোধ অক্ষ’-এ হিজবুল্লাহর ভূমিকা এখন হ্রাস পেতে পারে বলে মনে করেন উইলসন সেন্টারের বিশ্লেষক জো ম্যাকারন। তবে বশির সাদি মনে করেন, নাসরুল্লাহর মৃত্যু হিজবুল্লাহর প্রতি আঞ্চলিক সমর্থনকে আরও দৃঢ় করবে।
ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহর এই যুদ্ধবিরতি শুধু লেবানন ও ইসরায়েলের ওপরই নয়, গোটা মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে। যদিও এই চুক্তি অস্থায়ী শান্তি আনতে পারে, তবুও দীর্ঘমেয়াদে এই সংঘাতের পুনরাবৃত্তি ঠেকানো এবং মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতা আনতে আরও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।