আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর, অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ দাঁড়িয়ে গেছে—ব্যাংক খাতের সংস্কার। কারণ, পূর্ববর্তী সরকারের সময়ে এই খাতটি সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে একটি শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি ব্যাংক খাতকে কৃষ্ণগহ্বরের (ব্ল্যাকহোল) সঙ্গে তুলনা করেছে। তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, দেশের ব্যাংক খাতে দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের পরিমাণ এখন ৬ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা। এই খাতটি যেন বিধ্বস্ত হয়ে গেছে, রাষ্ট্রীয় সংস্থার সহায়তায় ব্যাংকগুলো দখল হয়ে গেছে। একটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর হাতে সাতটি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ তুলে দেওয়া হয়েছে, আর এই সুযোগে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করা হয়েছে।
দেশের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, ব্যাংক খাতে তদারকি ও নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের। এই নিয়ন্ত্রক সংস্থার সর্বোচ্চ ক্ষমতা গভর্নরের হাতে। তিনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যানও। আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি ক্ষমতা গ্রহণের সময় গভর্নর ছিলেন বর্তমান অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। তাঁর মেয়াদ শেষ হওয়ার পর নতুন গভর্নর হন আতিউর রহমান। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনায় তিনি পদত্যাগ করেন। তাঁর সময়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণে নতুন ব্যাংক অনুমোদন ও ঋণ পুনর্গঠন সুবিধা বিতর্কিত হয়ে পড়ে।
২০১৬ সালে সাবেক অর্থসচিব ফজলে কবির গভর্নর হলে ব্যাংক দখলের ঘটনা শুরু হয়। দখলকারীরা নির্বিচারে লুটপাট শুরু করে। নতুন ব্যাংক অনুমোদন ও ঋণ নীতিমালায় ছাড় দিয়ে খেলাপি ঋণ গোপন করার কৌশলও দেখা যায়। ২০২২ সালে গভর্নর পদে আব্দুর রউফ তালুকদার আসেন, কিন্তু তাঁর আমলেও আগের ধারা অব্যাহত থাকে। টাকা ছাপিয়ে দেওয়া হয় লুটপাট হওয়া ব্যাংকগুলোকে, এবং এসব টাকাও ঋণের নামে বের হয়ে যায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক হয়ে ওঠে লুটপাটের সহযোগী।
আতিউরের মেয়াদে অনিয়মের সূচনা ঘটে। ২০০৯ সালের পয়লা মে গভর্নর পদে নিয়োগ পাওয়ার পর, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ততটা ছিল না। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকিতে দুর্বলতা দেখা দেয়। সোনালী ব্যাংকে হলমার্কের জালিয়াতি ফাঁস হলে সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরামর্শে সোনালী ব্যাংকের পর্ষদে পরিবর্তন আনে। তবে বেসিক ব্যাংকে জালিয়াতি হলেও রাজনৈতিক চাপে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তা রুখতে পারেনি। ২০১২ সালে নতুন ব্যাংক অনুমোদনের উদ্যোগ নেওয়া হলে, তালিকা সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে গভর্নরকে দেওয়া হয়। আওয়ামী লীগ নেতাদের ৯টি ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়া হয়।
২০১৬ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চুরি হলে আতিউর রহমান পদত্যাগ করেন এবং ফজলে কবির গভর্নর হন। তাঁর সময়ে ইসলামী ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক দখল করে এস আলম গ্রুপ। গভীর রাতে ও বাসায় বসে এই দখল অনুমোদন দেন ফজলে কবির। এরপর ব্যাংকগুলোতে লুটপাট শুরু হলে তিনি তদারকি কমিয়ে দেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের অবাধ যাতায়াত শুরু হয় এস আলম গ্রুপের কর্মকর্তাদের।
এদিকে, খেলাপি ঋণের পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠছে। ২০০৯ সালে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা, যা গত সেপ্টেম্বরে প্রায় ১৩ গুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকায়। সরকারের পতনের পর, নতুন গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ আগামী দিনে মোট ঋণের ২৫ থেকে ৩০ শতাংশে পৌঁছাবে।
এস আলম গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ সাইফুল আলম ও তাঁর সহযোগীরা ব্যাংকব্যবস্থা থেকে অন্তত ১০ বিলিয়ন বা ১ হাজার কোটি মার্কিন ডলার পাচার করেছেন। জানা গেছে, এস আলম গ্রুপ ইসলামী ব্যাংকের দেওয়া মোট ঋণের প্রায় অর্ধেক, ইউনিয়ন ব্যাংকের ঋণের ৬৪ শতাংশ, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ৬০ শতাংশ ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ৯০ শতাংশ নিয়ে গেছে। সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, সিকদার পরিবার—সবাই বড় অঙ্কের অর্থ তুলে নিয়েছে।
এভাবে, ব্যাংক খাতের দুরবস্থা ক্রমশ গভীর হচ্ছে, আর দেশের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে।