অন্তর্বর্তী সরকারের দেড় বছর পার হলেও দেশের অর্থনীতি এখনও পুরোপুরি স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরেনি। তবে এই সময়ের মধ্যে অর্থনীতির রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়েছে এবং ডলার সংকট প্রশমিত হওয়ার মতো ইতিবাচক পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। বৈদেশিক খাতে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা কিছুটা স্বস্তির মুখ দেখেছে। রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় বাড়ার ফলে বাজারে ডলারের সরবরাহ বেড়েছে এবং ডলারের বিনিময় হার কিছুটা স্থিতিশীল হয়েছে। তবে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির পরিস্থিতি এখনও মন্থর এবং নানা চ্যালেঞ্জের সামনে রয়েছে। বিগত কয়েক বছরে করোনাভাইরাস মহামারির কারণে দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের মন্দা দেখা দিয়েছে, যা এখনও কাটিয়ে ওঠা কঠিন হয়েছে। ২০২০ সাল থেকে দীর্ঘমেয়াদী মন্দা প্রবাহ অব্যাহত রয়েছে, যা দেশের অর্থনীতিকে একটি দুষ্টচক্রে আবদ্ধ করেছে। আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সময়ে ব্যাপক লুটপাট ও অব্যবস্থাপনার কারণে ব্যাংক খাত দুর্বল হয়ে পড়েছিল এবং খেলাপি ঋণের পরিমাণ দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছিল। বর্তমান সরকার এই পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে, যার ফলে টাকার পাচার কমেছে, ব্যাংকে আমানত বেড়েছে এবং বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ নিয়মিত হচ্ছে। ডলারের দাম বিগত সরকারের সময়ে উচ্চ অঙ্কে ওঠার পর সাম্প্রতিক সময়ে তা কিছুটা কমে এসেছে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার একটি গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত। এ ছাড়া আমদানির নিয়ন্ত্রণে থাকা এবং বকেয়া ঋণের বড় অংশ পরিশোধের ফলে অর্থনীতির বৈদেশিক চাপ কিছুটা কমেছে। তবে রপ্তানি খাত সাম্প্রতিক সময়ে নানা বৈশ্বিক ও দেশীয় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি, যার কারণে কিছু মাস রপ্তানি আয় কমার প্রবণতা দেখা দিয়েছে। অর্থনীতির অভ্যন্তরীণ অংশে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা এখনও বিদ্যমান রয়েছে। এই অবস্থা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ভয় সৃষ্টি করছে, ফলে নতুন বিনিয়োগের গতি খুবই মন্থর। বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ কমে যাওয়ায় কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও শিল্প উৎপাদনেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। ঋণের সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসায়িক খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকার সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি গ্রহণ করলেও মূল্যের ঊর্ধ্বগতি এখনও ঝুঁকিপূর্ণ পর্যায়ে রয়েছে। নাগরিকদের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ায় জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে, আর সঞ্চয় কমে গিয়ে অনেকেই ঋণগ্রস্ত হয়েছেন। এ অবস্থায় দেশের আর্থিক টেকসইতা এবং সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য বিশেষ নজরদারি প্রয়োজন। আইএমএফসহ আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থাগুলো সরকারের স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য করের বোঝা বাড়ানোর সুপারিশ করেছে, যা কিছু ক্ষেত্রে কার্যকর হলেও রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। এর ফলে সরকার উন্নয়নমূলক ব্যয় কমাতে না পেরে ঋণের ওপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। সার্বিকভাবে বলা যায়, অন্তর্বর্তী সরকারের দেড় বছর সময়ের মধ্যে অর্থনীতির কিছু সংকট প্রশমিত হলেও ব্যাপক উন্নতি হয়নি। অর্থনৈতিক পুনর্জীবনের জন্য চলমান সংস্কার ও কার্যকর নীতি গ্রহণ অপরিহার্য। আগামী সময়ে এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়িত হলে দেশের অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা এবং প্রবৃদ্ধি প্রত্যাশিত। তবে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নয়নের জন্য আরও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের প্রয়োজন রয়েছে, যা দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও জনগণের জীবনমান উন্নতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।