আজ ১৩ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

সময় : রাত ৩:৩৩

বার : শুক্রবার

ঋতু : গ্রীষ্মকাল

নির্বাচনের আগে দল ভাঙার শঙ্কা বিএনপির

নির্বাচনের আগে দল ভাঙার শঙ্কা বিএনপির

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ‘দল ভেঙে’ যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে বিএনপির। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় এই শঙ্কা করছেন নেতারা। দলের হাইকমান্ডের সাম্প্রতিক বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্তে এই অবস্থা স্পষ্ট হয়েছে। এই শঙ্কা থেকে বিএনপির শীর্ষনেতৃত্ব ইতোমধ্যে আস্থাভাজন কয়েকজন নেতাকে নজরদারি করার দায়িত্ব দিয়েছেন। সংশ্লিষ্টরা কোথায় যাচ্ছেন, কার সঙ্গে কথা বলছেন, কোন প্রোগ্রামে অংশ নিচ্ছেন— এসবই পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।

বিএনপির নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির সদস্যদের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, নির্বাচনে অংশ না নিলে বিএনপির কিছু নেতা নির্বাচনমুখী হতে পারেন। গত এক-দেড় বছরে যেসব গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে নানা কারণে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে বা পদাবনতি দেওয়া হয়েছে, এই নেতাদের ঘিরে আশঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে বিএনপিতে।

দলীয়ভাবে গত দুই বছরে বেশ কয়েকজন সিনিয়র ও গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে দল থেকে সরিয়ে দিয়েছে বিএনপি। কোনও কোনও নেতাকে শোকজ করা হয়েছে। কাউকে পদাবনতি দেওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাংবাদিক নেতা শওকত মাহমুদ।

সর্বশেষ ঢাকায় প্রেস ক্লাবের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ করায় চলতি মাসের ৫ এপ্রিল শওকত মাহমুদের কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছে দল। এ বিষয়ে শওকত মাহমুদ বৃহস্পতিবার (২১ এপ্রিল) বিকালে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দল আমার কাছে ব্যাখ্যা চেয়ে চিঠি দিয়েছিল। আমি সেই চিঠির ব্যাখ্যা দিয়েছি। কিন্তু যেহেতু দলও চিঠির বিষয়বস্তু উল্লেখ করেনি, তাই আমিও আমার ব্যাখ্যার বিষয় উল্লেখ করবো না।’

অনুমতি ছাড়া সমাবেশ করায় শওকত মাহমুদকে বেশ কয়েকবার শো’কজ করা হয়। ২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর ‘সরকারের পতনের’ লক্ষ্যে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে বিক্ষোভ ও জমায়েত করা হয়। সেই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকায় ওই সময়ে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান হাফিজউদ্দিন আহমেদ ও শওকত মাহমুদকে কারণ দর্শাও নোটিশ দেওয়া হয়েছিল।

স্থায়ী কমিটির একজন সদস্যের পর্যবেক্ষণ— যারা দলের মৌলিক নীতির বাইরে গিয়ে ‘সরকারবিরোধী অবস্থা’ দেখাতে সক্রিয়, তারাই মূল সন্দেহভাজন। বিশেষত, দলের ওপর যেকোনও ‘স্যাবোটাজ’ চাপাতে এরা সরকারের হয়ে কাজ করছে, এমন সন্দেহ আছে। দৃশ্যত বিদেশি কিছু সংস্থার সহযোগিতা থাকার কথা উল্লেখ করলেও আদতে এসবের কোনও বাস্তবতা নেই, বলেও দাবি করেন স্থায়ী কমিটির এই সদস্য।

বিএনপির চেয়ারপারসনের মিডিয়া উইংয়ের গুরুত্বপূর্ণ একজন দায়িত্বশীল মনে করেন, তারা যা করছে, তা দলের নলেজে রেখে করা হলেই সন্দেহ থাকে না। সমস্যা হচ্ছে, নিজেরা নিজে থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে। এ কারণেই মূল সমস্যা।

দলের ভেতরে নির্বাচনের আগে দল ভাঙার আশঙ্কার বিষয়ে শওকত মাহমুদের জবাব, ‘এগুলোর সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক নেই, আমি সম্পৃক্ত নই। হ্যাঁ, হয়তো দলের পেশাজীবীরা চায় একটি আন্দোলন গড়ে তুলতে, কিন্তু এ ধরনের কোনও বিষয় এখানে যুক্ত নেই। যারা বলে তারা সম্পূর্ণ অমূলক কথা বলে।’

২০২০ সালের ৩০ ডিসেম্বর তৈমুর আলম খন্দকারকে আহ্বায়ক ও অধ্যাপক মামুন মাহমুদকে সদস্য সচিব করে নারায়ণগঞ্জ জেলা কমিটির অনুমোদন দেয় বিএনপি। ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি এ কমিটির নাম প্রকাশ করা হয়। গত বছরের ২৫ ডিসেম্বর তাকে আহ্বায়কের পদ থেকে সরিয়ে আরেক নেতাকে ‘ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক’ করা হয়। দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করায় চলতি বছরের ৩ জানুয়ারি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টার পদ থেকে সরিয়ে নেওয়া হয় তৈমুর আলমকে। নির্বাচনের পর ১৮ জানুয়ারি দলের প্রাথমিক সদস্যপদও হারান তিনি।

দলীয় সূত্র বলছে, নাসিক মেয়র নির্বাচনে সরকার দলীয় এমপি শামীম ওসমানের সঙ্গে তৈমুর আলম খন্দকারের ‘বোঝাপড়া’ সৃষ্টি হয়েছিল। সে কারণে দলের হাইকমান্ডের কাছে তৈমুরকে ঘিরে সন্দেহ বাড়ে। দায়িত্বশীল একজনের ভাষ্য— এক-এগারোর পর থেকে বিএনপির নেতৃত্বে ‘অবিশ্বাস-সন্দেহের মাত্রা’ অনেক বেশি। যে নেতাকেই সন্দেহজনক মনে হয়, তার ক্ষেত্রে কঠোর অবস্থান নিয়েছে হাইকমান্ড।

তৈমুর আলম খন্দকার জানিয়েছেন, নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি হলে তিনি সেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন। তার ভাষ্য, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে কোনও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন না।

তৈমুর আলম বলেন, ‘আমি অন্য কোনও দলে যোগ দেবো না। দল থেকে না দিলে প্রয়োজনে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করবো। তবে আগে শর্ত হচ্ছে, নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি হওয়া। আমার নির্বাচনের অভিজ্ঞতা আছে। দেখা যাবে, ওপরে শান্তিপূর্ণ কিন্তু কর্মীদের বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে নেওয়া হয়, পুলিশ এজেন্টদের খাবার নিতে দেয় না। ইভিএমে ভোট করারও অভিজ্ঞতা আছে, সরকার কীভাবে নারায়ণগঞ্জে ভোট করে নিলো। সুতরাং, আমার প্রথম চেষ্টা হবে নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করা।’

নির্বাচনের আগে যাদের ঘিরে সন্দেহ বিএনপির, তাদের মধ্যে অন্যতম সাবেক কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক নজরুল ইসলাম মঞ্জু। গত বছরের ৯ ডিসেম্বর খুলনা মহানগর বিএনপির কমিটি থেকে তিনি ও তার অনুসারীরা বাদ পড়লে, তিনি আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন করেন। এরপর ডিসেম্বরের মাঝামাঝি তাকে সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ থেকে অব্যাহতি দেয় বিএনপি।

স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য ওই সময় বলেছিলেন, কেন্দ্রের কয়েকজন নেতা শীর্ষ নেতৃত্বকে ভুল বুঝিয়ে মঞ্জুকে অব্যাহতি দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে। চলতি এপ্রিলে এই নেতা আবার এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে দাবি করেন— নির্বাচনের আগে যাদের পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে, মঞ্জু তাদের অন্যতম। স্থানীয়ভাবে জনপ্রিয় হওয়ায় তাকে কাজে লাগানো সহজ, বলেও মনে করেন এই নেতা। এ বিষয়ে মঞ্জুর সঙ্গে কয়েকদফায় যোগাযোগ করা হলেও তিনি কোনও সাড়া দেননি।

স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য জানান, দলের মধ্যে বেশ কয়েকজন নেতাকেই পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। শীর্ষ নেতৃত্ব এই কাজে বেশ কয়েকজনকে দায়িত্ব দিয়েছেন। দলের সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক শৃঙ্খলা অক্ষুণ্ন রাখতে তিনি এই ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। তবে কাকে কাকে এ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তা গোপন রাখা হয়েছে।

গত ৫ এপ্রিল বিএনপি জোট সরকারের শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী আ ন ম এহসানুল হক মিলনকে দলের আন্তর্জাতিক  বিষয়ক সম্পাদকের পদ থেকে নির্বাহী সদস্য করা হয়। তাকে নিয়েও দলের বিভিন্ন ধরনের আলোচনা রয়েছে। স্থায়ী কমিটির একজন সদস্যের দাবি, আমেরিকায় বিএনপিকে সংগঠিত করতে এহসানুল হক মিলনকে দায়িত্ব দেওয়ার পর, সেখান থেকে অভিযোগ আসে। সেই অভিযোগের পর দলের হাইকমান্ড তাকে পদাবনতি দেন।

প্রভাবশালী একজন দায়িত্বশীলের দাবি, বিএনপি নেতা শওকত মাহমুদ, কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কারণে পদাবনতি দেওয়া হয়েছে। যদিও মিলনের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্রের বক্তব্য— দলের পলিসির বাইরে যেসব নেতা ব্যাংকক ও  আমেরিকায় বিভিন্ন বৈঠকে অংশগ্রহণ করেছেন, তারা দলে সমাদৃত হয়ে আছে।

এসব বিষয়ে এহসানুল হক মিলনের সঙ্গে আলাপ হয়। দল ভাঙার বিষয়ে সাবেক এই শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘দলের অবমাননা যারা করে ক্ষেত্র বিশেষে তাদের জন্য এটা প্রযোজ্য। এটা হতে পারে। কিন্তু আমার বিষয়টি আলাদা। যারা ঘর গড়ে, তারা ঘর ভাঙে না। আমি এই দলে জন্মেছি, জন্ম দিয়েছি। জন্মলগ্ন থেকে গত ৪২ বছর ধরে বিএনপিতে আছি আমি। ফলে আমার বিষয়টি অন্য কারও সঙ্গে মিলবে না।’

এহসানুল হক মিলন উল্লেখ করেন, দলে যারা নতুন বা পরে যুক্ত হয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে দল ভাঙার বিষয়টি সত্য হতে পারে। অনেকে দলে পরে যোগ দিয়েছে, আবার চলেও গেছে। কিন্তু যারা দল গড়েছে, দলের জন্ম দিয়েছে, তারা দল ভাঙবে না। দল ভাঙার কথাটা অন্যের বেলায় যায়, আমার বেলায় যায় না। যারা দলে পরে এসেছে, যারা অতীতে সংস্কার চেয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে এটা সম্ভব।

বিএনপির প্রভাবশালী নেতাদের কাছে এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দলের হাইকমান্ডের কাছে স্থায়ী কমিটির কোনও সদস্যের বিষয়ে এখনও কোনও সন্দেহজনক কিছু যায়নি। নীতিনির্ধারকদের কেউ ফাঁদে পড়বেন না, এমন আস্থা এখনও বহাল রয়েছে বলে মনে করছেন তারা। তবে ‘জাতীয় সরকার’ বিষয়ে পূর্বালোচনা না হওয়ায় সিনিয়র একজন নেতা রুষ্ট হয়েছে বলে দাবি করেছেন স্থায়ী কমিটির একজন নেতা।

দলের গুরুত্বপূর্ণ একজন দায়িত্বশীলের ভাষায়, মূল স্রোতের বাইরে গিয়ে অবাস্তব রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা কিংবা চিন্তাধারা বাস্তবসম্মত হয় না। এক্ষেত্রে বিএনপি নেতাদের জন্য অধ্যাপক একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, কর্নেল (অব.) অলি আহমদ উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

গত মঙ্গলবার (১৯ এপ্রিল) স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘এই সরকারের পক্ষে যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। কারা যাবে এটার ওপর তা নির্ভর করে না। অতীতে বিএনপিকে ভাঙার অনেকবার চেষ্টা হয়েছে, কিন্তু সফল হয়নি। বিএনপির মূল হচ্ছে খালেদা জিয়া, তারেক রহমান ও দলের তৃণমূল। এর বাইরে দু’চার জনকে ভাগিয়ে নিয়ে বিএনপি বানাবে— এটা অলীক স্বপ্ন। ১/১১ সময় পারেনি, এখনও পারবে না। যারা দলের সঙ্গে বেঈমানি করবে, তারা রাস্তাঘাটে মার খাবে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     More News Of This Category