টানা দরপতনের বৃত্তে আটকে গেছে দেশের শেয়ারবাজার। সপ্তাহের চতুর্থ কার্যদিবস বুধবার (১৫ মে) দরপতনের মাধ্যমে টানা চার কার্যদিবস শেয়ারবাজারে দরপতন হলো। চারদিনে প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান মূল্যসূচক কমলো ১৩৪ পয়েন্ট। রিজার্ভ কমে যাওয়ার সংবাদ, রিজার্ভ চুরি হওয়ার গুঞ্জন, আগামী অর্থবছরের বাজেটে ক্যাপিটাল গেইন ট্যাক্স আরোপের গুঞ্জন এবং দাম কমার সর্বোচ্চসীমা ৩ শতাংশ বেঁধে দেওয়ার কারণে শেয়ারবাজারে এ টানা দরপতন হচ্ছে বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।
তারা বলছেন, গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হয়েছে বৈদেশি মুদ্রার রিজার্ভ ১৩ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে গেছে। আবার ভারতীয় গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে রিজার্ভ আবারও চুরি হয়েছে। এছাড়া আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে শেয়ারবাজারের ক্যাপিটাল গেইন ট্যাক্স আরোপ করা হবে বলেও গুঞ্জন ছড়িয়েছে। এর ফলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। বিনিয়োগকারীদের এ আতঙ্ক আরও বাড়িয়ে দিয়েছে দাম কমার সর্বোচ্চসীমা ৩ শতাংশ বেঁধে দেওয়া।
এর আগে ফ্লোরপ্রাইস শেয়ারবাজারের অনেক ক্ষতি করেছে। এখন দাম কমার সীমা ৩ শতাংশ বেঁধে দেওয়ায় মাধ্যমে আবারও বাজারের স্বাভাবিক পরিবেশ নষ্ট করা হয়েছে। আতঙ্কে অনেকেই লেনদেনের শুরুতেই দিনের সর্বনিম্ন দামে বিপুল শেয়ার বিক্রির চাপ বাড়াচ্ছেন। দাম কামার সর্বোচ্চসীমা ৩ শতাংশ হওয়ায় অনেকেই সর্বনিম্ন দামেও শেয়ার বিক্রি করতে পারছেন না। ফলে বাজারে আতঙ্ক আরও বাড়ছে।
তাদের অভিমত, শেয়ারবাজার স্বাভাবিক রাখতে যতদ্রুত সম্ভব ৩ শতাংশের নিয়ম তুলে দিয়ে বাজারে স্বাভাবিক সার্কিট ব্রেকার চালু করতে হবে। সেইসঙ্গে আগামী বাজেটে ক্যাপিটাল গেইন ট্যাক্স বসানো হবে কি না, সেটা দায়িত্বশীলদের নিশ্চিত করতে হবে। সেইসঙ্গে রিজার্ভের বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকে স্পষ্ট করতে হবে।
বাজার পর্যালোচনায় দেখা যায়, বুধবার লেনদেনের শুরুতেই প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম কমে যায়। দিনের সর্বনিম্ন দামে অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের শেয়ার বিক্রির আদেশ দেন এক শ্রেণির বিনিয়োগকারীরা। ফলে লেনদেনের শুরুর দিকেই সূচকের বড় পতন হয়।
লেনদেনের শুরুতে দেখা দেওয়া এ নেতিবাচক প্রবণতা অব্যাহত থাকে লেনদেনের শেষপর্যন্ত। তবে লেনদেনের শেষদিকে কিছু বিমা কোম্পানির শেয়ার দাম বাড়ে। এতে সূচকের পতন কিছুটা কম হয়েছে। দিনের লেনদেন শেষে ডিএসইতে দাম বাড়ার তালিকায় নাম লিখিয়েছে ৬১টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিট। বিপরীতে দাম কমেছে ৩০১টি প্রতিষ্ঠানের। আর ৩৩টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে।
এতে ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স ৫৮ পয়েন্ট কমে ৫ হাজার ৫২৭ পয়েন্টে নেমে গেছে। অপর দুই সূচকের মধ্যে ডিএসই শরিয়াহ্ সূচক আগের দিনের তুলনায় ১২ পয়েন্ট কমে ১ হাজার ২১২ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। আর বাছাই করা ভালো ৩০টি কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএসই-৩০ সূচক আগের দিনের তুলনায় ১৪ পয়েন্ট কমে ১ হাজার ৯৭৭ পয়েন্টে অবস্থান করছে।
এ দরপতন সম্পর্কে ডিএসইর এক সদস্য বলেন, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান আমাদের বলেছেন- শেয়ারবাজারে ক্যাপিটাল গেইনের ওপর ট্যাক্স বসবে না। কিন্তু এখন গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে আগামী বাজেটে ক্যাপিটাল গেইন ট্যাক্স বসানো হবে। এ নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক আছে। এর সঙ্গে এখন যোগ হয়েছে রিজার্ভ ইস্যু। বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর এসেছে রিজার্ভ ১৩ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে গেছে। আবার রিভার্জ চুরির সংবাদ প্রকাশ করেছে ভারতীয় একটি গণমাধ্যমে। ফলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। এই আতঙ্ক আরও বাড়িয়ে দিয়েছে দাম কমার সীমা ৩ শতাংশ বেঁধে দেওয়া।
তিনি বলেন, দাম কমার সীমা ৩ শতাংশ বেঁধে দেওয়া বড় ভুল একটি সিদ্ধান্ত। বিনিয়োগকারীরা আটকে যেতে পারেন, এ আতঙ্ক লেনদেন শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ৩ শতাংশ কম দামে বা দিনের সর্বনিম্ন দামে শেয়ার বিক্রির চাপ বাড়াচ্ছেন। ফলে লেনদেনের শুরুতেই সূচকের বড় পতন হয়েছে। অনেক বিনিয়োগকারী দিনের সর্বনিম্ন দামে বিক্রির আদেশ বসিয়েও বিক্রি করতে পারেননি। ফলে তাদের আতঙ্ক আরও বেড়েছে। তাই বাজার ও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে ৩ শতাংশের এ নিয়ম তুলে দিয়ে স্বাভাবিক সার্কিট ব্রেকার চালু করা উচিত।
যোগাযোগ করা হলে মিডওয়ে সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আশিকুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, শেয়ারবাজারে কয়েকটি কারণে দরপতন হচ্ছে। এর মধ্যে একটি কারণ হচ্ছে জাতীয় দৈনিকে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে রিজার্ভ ১৩ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে গেছে। আবার ভারতীয় গণমাধ্যমে সংবাদ হয়েছে রিজার্ভ চুরি হয়েছে। রিজার্ভ নিয়ে এমন সংবাদ প্রকাশ হওয়ায় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। ফলে শেয়ারবাজারে টনা দরপতন দেখা যাচ্ছে। এখন রিজার্ভের প্রকৃত চিত্র কি সেটা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে স্পষ্ট করা উচিত।
তিনি বলেন, দরপতনের আর একটি কারণ হলো ক্যাপিটাল গেইন ট্যাক্স নিয়ে ছড়িয়ে পড়া গুঞ্জন। আমরা শুনে ছিলাম শেয়ারবাজারে ক্যাপিটাল গেইনের ওপর ট্যাক্স বসানো হবে না। কিন্তু এখন আবার গুঞ্জন ছড়িয়েছে আগামী বাজেটে ক্যাপিটাল গেইন ট্যাক্স বসানো হতে পারে। ফলে বাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতা সৃষ্টি হয়েছে। এর সঙ্গে দাম কামার সর্বনিম্ন সীমা ৩ শতাংশ বেঁধে দেওয়ায় বাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
তিনি আরও বলেন, বিনিয়োগকারীরা স্বাভাবিক লেনদেন করতে চাই। কিন্তু দাম কমার সীমা ৩ শতাংশ বেঁধে দেওয়ার কারণে স্বাভাবিক লেনদেন প্রক্রিয়া বাঁধা গ্রস্ত হচ্ছে। এক শ্রেণির বিনিয়োগকারী টাকা আটকে যেতে পারে, এমন শঙ্কায় শেয়ার বিক্রির চাপ বাড়াচ্ছেন। আর বিক্রির চাপ বাড়ায় বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
এদিকে সবকটি মূল্যসূচক কমার পাশাপাশি ডিএসইতে লেনদেনের পরিমাণও কমেছে। দিনভর বাজারটিতে লেনদেন হয়েছে ৫২৬ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। আগের কার্যদিবসে লেনদেন হয় ৬৬৪ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। সে হিসেবে লেনদেন কমেছে ১৩৮ কোটি ৩ লাখ টাকা।
এ লেনদেনে সব থেকে বেশি অবদান রেখেছে আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজের শেয়ার। কোম্পানিটির ১৯ কোটি ২১ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে। দ্বিতীয় স্থানে থাকা ই-জেনারেশনের ১৮ কোটি ৭ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে। ১৮ কোটি ২ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেনের মাধ্যমে তৃতীয় স্থানে রয়েছে ওরিয়ন ইনফিউশ।
এছাড়া ডিএসইতে লেনদেনের দিক থেকে শীর্ষ দশ প্রতিষ্ঠানের তালিকায় রয়েছে- নাভানা ফার্মাসিউটিক্যালস, বেস্ট হোল্ডিং, মালেক স্পিনিং, কোহিনূর কেমিক্যাল, প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্স, প্রগতী ইন্স্যুরেন্স এবং সি পার্ল বিচ রিসোর্ট।
অপর শেয়ারবাজার সিএসইর সার্বিক মূল্যসূচক সিএএসপিআই কমেছে ১০৪ পয়েন্ট। বাজারটিতে লেনদেন অংশ নেওয়া ২৩৪টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৩২টির দাম বেড়েছে। বিপরীতে দাম কমেছে ১৭৪টির এবং ২৮টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। লেনদেন হয়েছে ১৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা। আগের কার্যদিবসে লেনদেন হয় ১৪ কোটি ৭১ লাখ টাকা।
Leave a Reply