পাউবোর তথ্য অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টায় সুরমা নদী কানাইঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ১৪৫ সেন্টিমিটার, কুশিয়ারা নদী জকিগঞ্জের অমলশীদ পয়েন্টে বিপৎসীমার ১০২ সেন্টিমিটার, শেওলা পয়েন্টে ৫৬ সেন্টিমিটার, সারি নদীর পানি জৈন্তাপুরের সারিঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ৮৩ সেন্টিমিটার এবং সারিগোয়াইন নদীর পানি গোয়াইনঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ৫৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। বুধবারের চাইতে বৃহস্পতিবার সবগুলো নদীর পানিই বেড়েছে।উজান থেকে নেমে আসা ঢলে সিলেটে আকস্মিক বন্যা দেখা দিয়েছে। এতে বুধবার রাতের মধ্যে তলিয়ে গেছে পাঁচ উপজেলা।জেলায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন প্রায় তিন লাখ মানুষ।এ প্রতিবেদন লেখার সময় বৃহস্পতিবার দুপুরে দ্রুত বাড়ছিল পানি।এমন পরিস্থিতিতে আরও নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এরই মধ্যে বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে সিলেটের সব নদ-নদীর পানি।
পানিবন্দিদের জন্য জেলায় ৪৭০টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এ ছাড়া তাদের উদ্ধারে প্রস্তুত রাখা হয়েছে সেনাবাহিনীকে।
বন্যাদুর্গত এলাকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, নৌকার অভাবে তারা আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে পারছেন না। ঢলে নদী রক্ষা বাঁধ ভেঙে পানি লোকালয়ে ঢুকছে।সিলেটের উজানে অবস্থান ভারতের মেঘালয় ও আসাম রাজ্যের। এসব রাজ্যের ভারি বৃষ্টি হলে বৃষ্টির পানির ঢল সিলেটের দিকে নেমে আসে।
ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে গত কয়েক দিন ধরে ব্যাপক বৃষ্টি হয় মেঘালয়ে। এতে করে ঢল নেমে আসে সিলেটের সীমান্তবর্তী পাঁচ উপজেলা গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, কোম্পানীগঞ্জ, কানাইঘাট ও জকিগঞ্জ উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা তলিয়ে গেছে।
দুর্গত এসব এলাকার বাসিন্দারা জানান, গত সোমবার থেকে ভারি বৃষ্টির সঙ্গে ঢল নামা শুরু হয়। এতে বাড়তে থাকে পানি, তবে বুধবার বিকেল থেকে অস্বাভাবিক হারে পানি বাড়তে শুরু করে।
রাতের মধ্যেই তলিয়ে যায় এই পাঁচ উপজেলার বেশির ভাগ এলাকা। রাতেই পানি ঢুকে পড়ে এসব এলাকার বেশির ভাগ বাসাবাড়িতে।অনেকের ঘরে গলা পর্যন্ত পানি উঠে যায়। এতে আতঙ্ক দেখা দেয় বন্যাকবলিত এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে। উদ্ধারের আকুতি জানিয়ে অনেকই রাতে ফেসবুকে পোস্টও দেন।
সীমান্তবর্তী পাঁচ উপজেলার সব ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে জানিয়ে সিলেট জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আব্দুল কুদ্দুস বুলবুল বলেন, ‘তিন লাখের মতো লোক বন্যায় আক্রান্ত হয়েছেন।’
জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পুরো জেলায় ৪৭০টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত পাঁচ উপজেলার মধ্যে গোয়াইনঘাটে ৫৬টি, জৈন্তাপুরে ৪৮টি, কানাইঘাটে ১৮টি, কোম্পানীগঞ্জে ৩৫টি ও জকিগঞ্জে ৫৮টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে।
এদিকে অনেক সড়ক ডুবে যাওয়ায় বন্ধ হয়ে পড়েছে যান চলাচল। বন্যার কারণে জাফলং, সাদাপাথরসহ কয়েকটি পর্যটনকেন্দ্রে পর্যটকদের আপাতত না আসার আহ্বান জানিয়েছে উপজেলা প্রশাসন।
জৈন্তাপুর উপজেলার ময়নারহা খেয়াঘাট এলাকার বাসিন্দা সাজিদুর রহমান সাজন বুধবার রাতে আকুতি জানিয়ে ফেসবুকে লিখেন, ‘হায়রে ফেরিঘাটের নৌকা। একটা নৌকা নাইনি বাছাইবার লাগি। লাশ উদ্ধার অইমু হয়তো, জীবিত উদ্ধার অইতে পারতাম না। হয়তো এইটা শেষ পোস্ট।’
ভয়ে এমন পোস্ট দিয়েছিলেন জানিয়ে বৃহস্পতিবার দুপুরে সাজিদুর বলেন, ‘রাতে হু হু করে বাড়তে থাকে পানি। রাত ১০টার দিকে ঘরে পানি ঢুকে যায়। ১১টার দিকে ঘরের পানি হাঁটুর ওপরে উঠে যায়, কিন্তু ঘরে নারী ও শিশুদের অন্যত্র নেয়ার জন্য কোনো নৌকা পাচ্ছিলাম না।
‘রাতের কারণে কোনো মাঝি নৌকা চালাতে রাজি হচ্ছিল না। এমন অবস্থায় আতঙ্কে ফেসবুকে এমন পোস্ট দিই।’
পরে রাতেই তার পরিবারকে স্থানীয়রা উদ্ধার করে আনেন বলে জানান সাজিদুর।
গোয়াইনঘাট উপজেলার রুস্তমপুর ইউনিয়ন, লেঙ্গুড়া, ডৌবাড়ি, নন্দীরগাঁও, পূর্ব ও পশ্চিম আলীরগাঁও, পশ্চিম জাফলং, মধ্য জাফলং ইউনিয়ন সবচেয়ে বেশি প্লাবিত হয়। এসব উপজেলার অনেক বাসিন্দাই আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেন, তবে গবাদি পশু আর গোয়ালের ধান নিয়ে বিপাকে পড়েন অনেকে।
রুস্তমপুর এলাকার বাসিন্দা ফয়জুর রহমান বলেন, ‘ঘরে কাল রাতে পানি উঠে গেছে, কিন্তু ঘরের শিশু ও নারীদের অন্যত্র রেখে এসেছি।
‘গোয়ালের গরুর কারণে আমি কোথাও যেতে পারছি না। আশপাশের সব জায়গা পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় গরুগুলো কোথাও নিতেও পারছি না। এভাবে আরও দুই-একদিন গেলেই গো-খাদ্যের সংকট দেখা দেবে।’
এ উপজেলার সালুটিকর-গোয়াইনঘাট সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে উপজেলা সদরের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের দেয়া (পাউবো) তথ্য অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টায় সুরমা নদী কানাইঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ১৪৫ সেন্টিমিটার, কুশিয়ারা নদী জকিগঞ্জের অমলশীদ পয়েন্টে বিপৎসীমার ১০২ সেন্টিমিটার, শেওলা পয়েন্টে ৫৬ সেন্টিমিটার এবং সারি নদীর পানি জৈন্তাপুরের সারিঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ৮৩ সেন্টিমিটার এবং সারিগোয়াইন নদীর পানি গোয়াইনঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ৫৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। বুধবারের চাইতে বৃহস্পতিবার সবগুলো নদীর পানিই বেড়েছে।
এভাবে ভারি বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল অব্যাহত থাকলে কানাইঘাটে ভয়াবহ বন্যা দেখা দিতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে।
কানাইঘাট উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের মধ্যে লক্ষীপ্রসাদ পূর্ব ইউনিয়ন, লক্ষীপ্রসাদ পশ্চিম ইউনিয়ন, কানাইঘাট সদর, দক্ষিণ বাণীগ্রাম ইউনিয়ন সবচেয়ে বেশি প্লাবিত হয়।
কানাইঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফারজানা নাসরিন জানান, আকস্মিক ঢল ও বৃষ্টিপাতের কারণে সুরমা ও লোভা নদীর পানি বেড়ে বন্যা দেখা দেয়। এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় উপজেলার সব আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত।
এদিকে বৃহস্পতিবার দুপুরে কোম্পানীগঞ্জের ইউএনও সুনজিত কুমার চন্দ সাক্ষরিত আদেশে বলা হয়, ‘ধলাই নদীর পানি অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি হওয়ায় ও পর্যটনকেন্দ্রসমূহ পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত সাদাপাথর পর্যটনকেন্দ্রসহ সকল পর্যটনকেন্দ্র বন্ধ ঘোষণা করা হলো।’
সিলেটে বৃষ্টি অব্যাহত থাকতে পারে জানিয়ে সিলেট আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ শাহ মোহাম্মদ সজিব হোসেন বলেন, ‘চলতি মাসের ৩০ দিনে সিলেটে ৭০৫ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছিল। অথচ গত বছর মে মাসে বৃষ্টি হয়েছিল ৩৩০ মিলিমিটার।
‘আগামী তিন দিন সিলেটে অস্থায়ী দমকা হাওয়ার পাশাপাশি হালকা থেকে মাঝারি ঝোড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে।’
সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোবারক হোসেন জানান, আকস্মিক বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় জেলা প্রশাসন সার্বিক প্রস্তুতি নিয়েছে। সব ইউএনওকে সার্বক্ষণিক তদারকির নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, পানিবন্দি মানুষকে উদ্ধারে সেনাবাহিনী প্রস্তুত; প্রয়োজন হলেই তৎপরতা শুরু হবে।
Leave a Reply