ফেনী সদর উপজেলার শর্শদি ইউনিয়নের ফতেহপুর গ্রামের ঈদগাহ মাঠে রোববার সকালে মানুষের ঢল নেমেছিল। এ জমায়েত ছিল মোজাম্মেল হোসেন নাঈমকে শেষ বিদায় জানাতে।
এদিন নাঈমের সশরীরে বাড়ি ফেরার কথা থাকলেও সে ফিরেছে নিথর দেহে। এলাকায় অত্যন্ত নম্র-ভদ্র, বিনয়ী ও মেধাবী হিসেবে পরিচিত এ তরুণকে চিরবিদায় জানানোর কথা যেন ভাবতেই পারছিলেন না কেউ। অনেক লোকজনের ভিড়েও শোকে স্তব্ধ ছিল চারপাশ; বাকরুদ্ধ ছিলেন নাঈমের পরিবার আর প্রতিবেশীরা।
নাঈমের জানাজা শেষে কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তার বাবা মোতাহের হোসেন শামীম। প্রতিবেশী-স্বজনদের কোনো সান্ত্বনাই শান্ত করতে পারছিল না তাকে।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে মোতাহের বলেন, “বাবার কাঁধে ছেলের মরদেহ পৃথিবীর সবচেয়ে ভারি বস্তু। সেই মরদেহের খাটিয়া বহন করতে হচ্ছে আমাকে। জানাজায় উপস্থিত সবাই আমার ছেলের জন্য দোয়া করবেন।”
পরে সকাল ১০টার দিকে ফতেহপুর ঈদগাহ মাঠে জানাজা শেষে দাদা-দাদির কবরের পাশে দাফন করা হয় নাঈমকে।
শনিবার গাজীপুরের শ্রীপুরে বনভোজনে যাওয়ার পথে দ্বিতল বাস বিদ্যুতায়িত হয়ে ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (ইইউটি) মেকানিক্যাল অ্যান্ড প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের এ শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়। এদিন রাত আড়াইটার দিকে নাঈমের লাশ গ্রামের বাড়িতে আনা হলে স্বজনদের আহাজারিতে চারপাশ ভারি হয়ে ওঠে।
শর্শদি ইউনিয়নের ফতেহপুর গোলাম নবী ভুঁইয়া বাড়ির মোতাহের হোসেনের শাহীন ও নাহিদা ইয়াসমিন দম্পতির দুই ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে নাঈম ছিলেন দ্বিতীয়। ২০১৯ সালে ফেনী সরকারি পাইলট উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করে ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজিতে ভর্তি হন। তাদের পরিবার ফেনী শহরের মাস্টারপাড়া এলাকায় বসবাস করছে। নাঈমের বড় ভাই বাকপ্রতিবন্ধী।
ফাজিলপুর সাউথ ইস্ট ডিগ্রি কলেজের হিসাববিজ্ঞানের অধ্যাপক মোতাহার বলেন, “আমার ছেলে নাঈম অত্যন্ত বিনয়ী ও মেধাবী ছিল। তাকে ঘিরেই আমাদের পরিবারের অনেক আশা ছিল। চোখের সামনে এভাবে সব শেষ হয়ে যাবে, মানতে পারছি না।”
নিহতের জ্যাঠাতো বোন সুরভী বলেন, “বনভোজনে যাওয়ার আগের রাতে মায়ের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা হয়েছিল নাঈমের। তখন সে মাকে বলেছিল, পিকনিক শেষে করে বাড়ি আসবো।”
“সেই থেকে চাচি ছেলের অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু ছেলের মৃত্যুর খবর শোনার পর থেকে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। অনেকটাই নির্বাক হয়ে পড়েছেন।”
নাঈমের ফুপাতো ভাই সোহাগ বলেন, “ভাই অনেক মেধাবী ছিলেন। ফেনী শহরের হলি ফ্যামিলি ক্রিসেন্ট স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে ফেনী পাইলট হাই স্কুলে ভর্তি হন তিনি। ২০১৯ সালে এসএসসি ও ২০২১ সালে এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছেন।”
এদিকে বাস বিদ্যুতায়িত হয়ে শিক্ষার্থীদের মৃত্যুর ঘটনায় জড়িতদের তদন্তের মাধ্যমে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন নিহতের চাচা মুফতি মোফাচ্ছের হোসেন মামুন।
তিনি বলেন, “আমার ভাই-ভাবির স্বপ্ন ছিল নাঈমকে দেশের সেরা প্রকৌশলী করা। কিন্তু সেই স্বপ্ন ধূলিসাৎ হলো। নাঈমের মৃত্যুর জন্য পল্লী বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ দায়ি। তাদের অবহেলার কারণে এত বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে।”
ফেনী সরকারি কলেজের সহকারী অধ্যাপক হাবিবুর রহমান বলেন, “২০০৯ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত প্রায় ১৪ বছর নাঈমদের বাসায় ভাড়া ছিলাম। আমরা পাশাপাশি ফ্ল্যাটে থাকতাম।
“নাঈমকে ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি। এত ভদ্র ও বিনয়ী ছিল যা বর্ণনাতীত। তার এমন করুণ মৃত্যু মেনে নেওয়া যায় না।”
গত শনিবার সকালে ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের প্রায় ৪৬০ জন শিক্ষার্থী বিআরটিসির ৬টি ডাবল ডেকার বাস ও তিনটি মাইক্রোবাসে করে উপজেলার তেলিহাটি ইউনিয়নের উত্তর পেলাইদ গ্রামের মাটির মায়া ইকো রিসোর্টে যাচ্ছিলেন।
গন্তব্য থেকে মাত্র আধা কিলোমিটার দূরে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে বাসগুলো আঞ্চলিক সড়ক ধরে রিসোর্টের দিকে যাওয়ার সময় উত্তর পেলাইদ গ্রামের বোর্ড বাজার এলাকার উদয়খালী বাজারে বিআরটিসির একটি ডাবল ডেকার বাস পল্লী বিদ্যুতের তারের সঙ্গে লেগে যায়। বাসের দরজার দিকে থাকা তিনজন বিদ্যুতায়িত হয়ে গুরুতর আহত হন।
তাদের উদ্ধার করে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে নিয়ে গেলে চিকিৎসকেরা মৃত ঘোষণা করেন।