“প্রধান উপদেষ্টা বা অন্তর্বর্তী সরকার যখন চাইবে, তখনই নির্বাচন করতে প্রস্তুত ইসি।” এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে নির্বাচন কমিশনের অবস্থান স্পষ্ট হলেও, গত বুধবার এনএইচকেকে দেওয়া প্রধান উপদেষ্টার সাক্ষাৎকারে ‘২০২৬ সালের প্রথমার্ধ’—এই সময়সীমা থেকে সরে আসার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। একই দিনে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলমের মন্তব্য, “আগামী জাতীয় নির্বাচন এ বছরের শেষ নাগাদ, নাকি আগামী বছরের জুনের মধ্যে হবে তা নির্ভর করছে জুলাই চার্টারের ওপর,” বিষয়টিকে আরও জটিল করে তোলে। জুলাই চার্টার, যা রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য গঠিত নির্বাচনব্যবস্থা ও সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করছে, কিন্তু এর কাজ সম্পন্ন করার সময়সীমা এখনও অজানা।
প্রধান উপদেষ্টার সাক্ষাৎকারের দিন রাতেই, দেশের বিভিন্ন স্থানে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভের ঘটনা ঘটে। ছাত্র-জনতার এই অভ্যুত্থানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর সহযোগীদের উসকানিমূলক আচরণ এবং জুলাই-আগস্টের রক্তক্ষয়ী ঘটনার প্রতি অশালীন মন্তব্য দেশের জনগণের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের জন্ম দেয়। এর ফলস্বরূপ, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পতিত স্বৈরাচারের স্মৃতি, মূর্তি, স্থাপনা ও নামফলকগুলো ভেঙে ফেলার মতো জনস্পৃহা দৃশ্যমান হয়।
বিএনপির বিবৃতিতে বলা হয়, “বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গত ছয় মাসেও পলাতক স্বৈরাচার এবং তাদের দোসরদের আইনের আওতায় আনতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি।” ফলে জনগণ আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার মতো বেআইনি কর্মকাণ্ডে উৎসাহিত হচ্ছে। বিএনপির মতে, “জুলাই ছাত্র-জনতা অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে মানুষের হারানো গণতান্ত্রিক অধিকার, সাংবিধানিক অধিকার, মানবাধিকারসহ ভোটাধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে যত শিগগির সম্ভব একটি নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠা করাই এখন সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার।”
নির্বাচনের সম্ভাবনা নিয়ে গত বছর সেপ্টেম্বরে একটি ধারণা পাওয়া যায়। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের সাক্ষাৎকারে বলা হয়, “গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার সম্পন্ন করে ১৮ মাসের মধ্যে নির্বাচনের লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকারকে পূর্ণ সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।” কিন্তু রাষ্ট্র সংস্কারের প্রত্যাশিত কাজ সম্পন্ন হবে কি না, সে প্রশ্ন এখনো অমীমাংসিত। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং বিশিষ্ট নাগরিকদের মধ্যে দ্রুত নির্বাচন নিয়ে ভিন্নমত প্রকাশের ঘটনা ঘটছে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী বলেন, “আমরা এই সময় নির্বাচন ‘হতে পারে’ বলে শুনছি। কিন্তু নির্দিষ্ট কোনো সময়ের কথা এখনো জানানো হয়নি।” তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে, যত সময় গড়াবে, দেশের সংকট ততই বাড়বে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও বলেন, “সংস্কার দীর্ঘায়িত হলে সমস্যা বাড়বে। আইনের শাসন ব্যবস্থা ভেঙে গেছে।”
এদিকে, জামায়াতে ইসলামীও নির্বাচনের আগে সংস্কারকে অধিকতর গুরুত্ব দিচ্ছে। তারা বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকায় নিজেদের প্রার্থীর নাম ঘোষণা করতে শুরু করেছে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীরা রাষ্ট্র সংস্কারের পর নির্বাচনের পক্ষে। তাঁরা নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করতে যাচ্ছেন, যার নেতৃত্বে আসছেন নাহিদ ইসলাম।
নির্বাচন কমিশনও আইন সংস্কারের অপেক্ষায় রয়েছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে ভোটার তালিকা চূড়ান্ত করা এবং নির্বাচনী আসনগুলোর সীমানা পুনর্নির্ধারণের কাজ করতে হবে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন জানান, “সংস্কারের সুপারিশগুলো এখনো না পাওয়ায় আমাদের অনেক কাজই শুরু হয়নি।” সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর ধারণা, প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন করতে এখনো পাঁচ-ছয় মাস লাগতে পারে।
অন্যদিকে, ফ্যাসিস্টদের বিচার এখনো অসম্পন্ন। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পক্ষের সব রাজনৈতিক দলের দাবি, “আগে আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের বিচার, তারপর নির্বাচন।”