বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৩৭ অপরাহ্ন

আছাদুজ্জামান স্ত্রী ও ছেলেমেয়ের নামেও বিপুল সম্পদ গড়েছেন

bornomalanews
  • Update Time : বুধবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
  • ৪৫ Time View

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়ার অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধানে দুই সদস্যের কমিটি গঠন করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

দুদকের উপপরিচালক মো. হুমায়ুন কবীরকে প্রধান করে গঠন করা এ কমিটির আরেক সদস্য হলেন দুদকের সহকারী পরিচালক মো. আলিয়াজ হোসেন। গত ১৯ আগস্ট এ কমিটি গঠন করে দুদক।

গাড়ি, বাড়ি, প্লট, ফ্ল্যাট-কী নেই আছাদুজ্জামান মিয়ার। রীতিমতো গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। শুধু নিজের নামেই নয়; স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে এবং শ্যালক-শ্যালিকার নামেও গড়েছেন বিপুল সম্পত্তি।

অভিযোগ রয়েছে-ডিএমপিতে ঘুস এবং বদলি বাণিজ্যে গড়ে তুলেছেন এসব সম্পদ। তার বিপুল সম্পদের বিষয়ে অনুসন্ধান চালাচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুকক)। যুগান্তরের অনুসন্ধানেও এসব সম্পদের সত্যতা মিলেছে। রাজধানীর অভিজাত এলাকা সিদ্ধেশ্বরীর ভিকারুননিসা স্কুলের পাশেই রূপায়ণ স্বপ্ন নিলয়। ৫৫/১ হোল্ডিংয়ে আলিশান এ ভবনটি ১১ তলা। এখানে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার বর্গফিটের একটি ফ্ল্যাট রয়েছে আছাদুজ্জামানের মেয়ে আয়েশা সিদ্দিকার নামে।

গত ২৫ আগস্ট দুপুরে সেখানে গেলে নিরাপত্তা ইনচার্জ আবুল কালাম আজাদ যুগান্তরকে বলেন, আমি মাস দেড়েক আগে এখানে চাকরি নিয়েছি। এই ভবনে ১৩০টি ফ্ল্যাট। তাই সব ফ্ল্যাট মালিককে ভালোভাবে চিনি না। বাড়ির ম্যানেজার সোহেল পারভেজ বিস্তারিত বলতে পারবেন। সোহেল পারভেজ জানান, আয়েশা সিদ্দিকার নামে এখানে একটি ফ্ল্যাট আছে। তবে তিনি কখনো এখানে আসেন না। এটি ভাড়া দেওয়া আছে।

ধানমন্ডি ১২/এ নম্বর রোডের ৬৯ নম্বর বাড়িতে রয়েছে একটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট। গত ২৫ আগস্ট দুপুরে ওই বাড়িতে যাওয়া হলে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি মেলেনি। তবে নিজের নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাড়ির একজন নিরাপত্তাকর্মী জানান, ধানমন্ডির ১২-এ রোডের ৬৯ নম্বর বাড়ির দ্বিতীয় তলার পুরো ফ্লোরটি সাবেক ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া কিনেছেন। তবে এটি তার শ্যালকের নামে।

ওই ভবনের তৃতীয় তলার ফ্ল্যাটটি চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) সাবেক কমিশনার ইকবাল বাহারের। এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি কৃষ্ণপদ রায় বলেন, ইকবাল বাহার হলেন আছাদুজ্জামান মিয়ার খুবই ঘনিষ্ঠ। তাই তারা দুজন একই ভবনে থাকতেন। আমিও একাধিকবার সেখানে গিয়েছি। আছাদুজ্জামান মিয়া কমিশনার থাকা অবস্থায় ওই ভবনে থাকতেন।

গত ২৫ আগস্ট বেলা আড়াইটায় ইস্কাটন গার্ডেন ১৩/এ প্রিয়নীড়ে গিয়ে জানা যায়, সেখানে আছাদুজ্জামানের স্ত্রীর নামে একটি ফ্ল্যাট রয়েছে। বিস্তারিত জানতে চাইলে নিরাপত্তাকর্মী আব্দুস সালাম ও শাহ আলম যুগান্তরকে বলেন, আমরা এখানে নতুন এসেছি, তাই তেমন কিছু জানি না। ভবনের ম্যানেজার আজাদ আহমেদ জানান, ১৪ তলা এই ভবনে ৪০টি ফ্ল্যাট আছে। বেশিরভাগ ফ্ল্যাটই ২১৩৩ বর্গফুটের। ভবনের ১১ তলায় আছাদুজ্জমানের স্ত্রী আফরোজা জামানের একটি ফ্ল্যাট আছে। তবে সেখানে তিনি থাকেন না। ফ্ল্যাটটি ভাড়া দেওয়া আছে। অভ্যর্থনাকারী আবু বকর প্রতি মাসে ভাড়া তুলে আছাদুজ্জামানের কাছে দিয়ে আসেন। ভাড়া বকেয়া পড়লে বা কোনো সমস্যা হলে আমি নিজে স্যারের সঙ্গে (আছাদুজ্জমান) যোগাযোগ করি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নিকুঞ্জ-১ এর ৮/এ রোডের ৬ নম্বর বাড়িটি আছাদুজ্জামানের ছোট ছেলে আসিফ মাহাদীনের নামে। শুক্রবার বিকালে সেখানে যাওয়া হলে বাড়িটি ভেতর থেকে বন্ধ পাওয়া যায়। বেশ কয়েকবার কলিংবেল টিপেও সাড়া পাওয়া যাচ্ছিল না। একপর্যায়ে পাশের চার নম্বর বাড়ির গাড়িচালকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল এই প্রতিবেদকের।

ওই গাড়িচালক জানান, ‘আছাদুজ্জামান মিয়া সপরিবারে এই বাড়িতে থাকতেন। সরকার পতনের পর তিনি বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। সম্প্রতি বাসার নেমপ্লেট খুলে রাখা হয়েছে। এই বাড়িটির মূল্য ১০ কোটি টাকার বেশি।’ কথা বলার একপর্যায়ে ৬ নম্বর বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায় একটি গাড়ি। তখন ওই গাড়িচালক বলেন, ওই দেখেন আছাদুজ্জামানের গাড়িচালক এসেছেন। পরে তিনি জানান, ‘তার নাম ফারুক। তিনি আছাদুজ্জামানের ছেলে মাহাদীনের গাড়ি চালান। আগে এই বাড়িতে সপরিবারে আছাদুজ্জামান মিয়া থাকতেন। এখন কেউ থাকেন না।’

এরই মধ্যে ভেতর থেকে উঁকি দেন এক ব্যক্তি। তিনি জানান, তার নাম রিয়াজুল। তিনিও একজন গাড়িচালক। বাড়িতে কে আছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখানে শুধু আমি, দু-একজন কেয়ারটেকার এবং স্যারের (আছাদুজ্জামান মিয়া) স্ত্রী আফরোজা জামান থাকেন।’ আফরোজা জামানের সঙ্গে দেখা করা যাবে কিনা-জানতে চাইলে বলেন, ‘আপনি একটু দাঁড়ান। আমি উনার অনুমতি নিয়ে আসি।’ বেশ কিছুক্ষণ পর তিনি এসে জানান, ‘ম্যাডাম কোনো কথা বলবেন না।’

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার এল ব্লকের ১ নম্বর রোডের ১৬৬ এবং ১৬৭ নম্বরে ১০ কাঠার ওপর ৬ তলাবিশিষ্ট আলিশান একটি বাড়ি আছাদুজ্জামানের স্ত্রী আফরোজা জামানের নামে। ওই বাড়িতে পরিচালিত হচ্ছে রিভেরিফ নামের একটি স্কুল। শুক্রবার বিকালে সেখানে গেলে স্কুলটি বন্ধ পাওয়া যায়। বাইরে থেকে নক করার পর বেরিয়ে আসেন এক ব্যক্তি।

তিনি যুগান্তরকে জানান, তার নাম রমজান আলী। তিনি এখানকার সিকিউরিটি ইনচার্জ। বাড়িটির বিষয়ে তিনি বিস্তারিত জানাতে না পারলেও বলেন, শুনেছি এই বাড়িটি ডিএমপির সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জমান মিয়ার স্ত্রীর নামে। তিনি বলেন, আমি আগে ধানমন্ডি ১২ নম্বরে লেকহেড গ্রামার স্কুলের কেয়ারটেকার ছিলাম। ওই রোডে আছাদুজ্জামান মিয়া থাকতেন। প্রায়ই লেকহেড গ্রামার স্কুলে এসে তিনি (আছাদুজ্জামান) ঝামেলা করতেন। পরে সেটি (স্কুল) বন্ধ হয়ে যায়। এরপর আমি এখানে এসে চাকরি নিই। স্থানীয় মোহাম্মদ আলী জানান, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার এই বাড়িটির বাজার মূল্য প্রায় ৫০ কোটি টাকা।

অনুসন্ধানে জানা যায়, পূর্বাচলের নিউ টাউনের ১ নম্বর সেক্টরের ৪০৬/বি নম্বর রোডে ১০ কাঠা জমি রয়েছে আছাদুজ্জামান মিয়ার নামে। ওই জমিতে গাড়ি রাখার শেড বানিয়ে রাখা হয়েছে। পূর্বাচলের এই প্লটের প্রতি কাঠা জমির মূল্য এক কোটি টাকারও বেশি। পূর্বাচলের সেক্টর ৪, রোড ১০৮-এ ৫৩ নম্বর প্লটটি আছাদুজ্জামানের স্ত্রীর নামে ছিল। ৫ কাঠার এই প্লটটি বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। আফতাবনগরে ৩ নম্বর সেক্টরে রয়েছে ২১ কাঠা জমি। সেখানে নিজের নামে ১০ কাঠা ও আত্মীয়স্বজনদের নামে রয়েছে বাকি ১১ কাঠা জমি।

সূত্র জানায়, আছাদুজ্জামান মিয়ার স্ত্রী আফরোজা জামানের নামে ঢাকা ছাড়াও ফরিদপুর ও নারায়ণগঞ্জে বিপুল সম্পদ রয়েছে। ২০১৮ সালে তিনি রাজউক থেকে বিশেষ কোটায় একটি প্লট বরাদ্দ পান। অথচ রাজউকের নীতিমালা অনুযায়ী, স্বামী-স্ত্রী উভয়ের প্লট বরাদ্দ পাওয়ার সুযোগ নেই।

জানা গেছে, গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার চাঁদখোলা মৌজায় আফরোজা জামানের নামে ৬৭ শতাংশ জমি রয়েছে। ২০১৭ সালে এই জমি কেনা হয়। ওই মৌজায় তার নামে ২০১৯ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি কেনা হয় আরও ৩৯ শতাংশ জমি। একই নামে ২০২০ সালে জোয়ার সাহারা মৌজায় কেনা হয় ১৫ কাঠা জমি। ওই বছর গাজীপুরের চাঁদখোলা মৌজায় ৩১ শতক জমি ক্রয় করেন আফরোজা। আফরোজা ২০১৮ সালে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কৈয়ামসাইল-কায়েতপাড়া মৌজায় দশমিক ২৮ একর জমি কেনেন। ওই বছর একই মৌজায় আরও ৩২ শতক জমি কেনেন তিনি। ওই বছরই রূপগঞ্জের কৈয়ামসাইল-কায়েতপাড়া মৌজায় দশমিক ৬০ একর জমি তার নামে কেনা হয়। পরে তা বিক্রি করে দেওয়া হয়। ২০১৯ সালে কৈয়ামসাইল-কায়েতপাড়া মৌজায় দশমিক ৫৭ একর জমির পাওয়ার অব অ্যাটর্নি পান আছাদুজ্জামানের স্ত্রী। এরপর ওই জমি বিক্রিও করেন।

যুগান্তরের অনুসন্ধানে আছাদুজ্জামান মিয়ার পরিবারের সদস্যদের মালিকানার দুটি কোম্পানির খোঁজ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে একটি হলো মৌমিতা ট্রান্সপোর্ট লিমিটেড। এর চেয়ারম্যান আছাদুজ্জামানের স্ত্রী আফরোজা। আছাদুজ্জামান ডিএমপি কমিশনার থাকাকালীন রাজধানীর রুট পারমিট কমিটির প্রধান ছিলেন। ওই সময় মৌমিতা পরিবহণকে রুট পারমিট দেওয়া হয়।

মৌমিতা ট্রান্সপোর্ট লিমিটেডের ভাইস চেয়ারম্যান হারিসুর রহমান সোহান হলেন আছাদুজ্জামানের শ্যালক। এক সময় তিনি লেবার ভিসায় সৌদি যান। পরে দেশে এসে ব্যবসা শুরু করেন। সোহানের নামে রাজধানীর নিউমার্কেটে আছে স্বর্ণের দোকান। আরও জানা যায়, শেপিয়ার্ড কনসোর্টিয়াম লিমিটেড নামে আরেকটি কোম্পানির চেয়ারম্যান আফরোজা জামান। এই কোম্পানির পরিচালক আছাদুজ্জামানের বড় ছেলে আসিফ শাহাদাত। আছাদুজ্জামানের শ্যালক নূর আলম ওরফে মিলনের নামে গাজীপুরের শ্রীপুরে দেড় একর জমি রয়েছে। ভাগনে কলমের নামেও গাজীপুরে জমি আছে দেড় একর।

গ্রামের বাসিন্দা কলমও বনে গেছেন কয়েক কোটি টাকার জমির মালিক। এই কলম আছাদুজ্জামানের গ্রামের বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক বলে জানা গেছে। এদিকে আছাদুজ্জামান মিয়ার অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। সংস্থাটির সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন গণমাধ্যমকে বলেন, আছাদুজ্জামান মিয়ার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ এসেছে। এই অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।

সম্পদের বিষয়ে জানতে গত ২৫ ও ২৬ আগস্ট একাধিকবার ফোন করা হলেও আছাদুজ্জামান মিয়া ও তার শ্যালক হারিসুর রহমান সোহানের মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়। তবে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের কয়েকদিন আগে আছাদুজ্জামান মিয়া যুগান্তরকে জানিয়েছিলেন, তার এবং পরিবারের সদস্যদের কোনো অবৈধ সম্পদ নেই। যেসব সম্পদ আছে সবই আয়কর বিবরণীতে উল্লেখ করা আছে। সরকারের কোনো সংস্থা যদি এসব সম্পদের বিষয়ে অনুসন্ধান চালায় তাহলে তিনি ও তার পরিবারের সদস্যরা ওই সংস্থাকে সহযোগিতা করবেন।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
© All rights reserved © 2024 bornomalanews24.com
Design & Develop BY Coder Boss
themesba-lates1749691102