২০২৪ সাল বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি অভূতপূর্ব সময় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। বছরজুড়ে চলা আন্দোলন, রক্তপাত এবং ক্ষমতার পালাবদলের মধ্য দিয়ে এই বছরটি কেবল দেশীয় রাজনীতির মোড় ঘুরিয়েছে নয়, বিশ্ববাসীর দৃষ্টিও আকর্ষণ করেছে।
বছরের শুরুতে বিতর্কিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে আবারও ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। তবে এই নির্বাচন ছিল পূর্বের দুই নির্বাচনের মতোই প্রশ্নবিদ্ধ। ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচন এবং ২০১৮ সালের রাতের ভোটের পর এবার ‘ডামি নির্বাচন’-এর মাধ্যমে ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টা করে দলটি।
এই নির্বাচনের আগে থেকেই বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে হামলা-মামলা, গ্রেপ্তার, এবং জুলুম চালানো হয়। বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন বর্জন করে। আওয়ামী লীগের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ‘ডামি প্রার্থী’ দিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতার নাটক সাজানো হয়। নির্বাচনের পর, দেশের অর্থনৈতিক সংকট এবং ব্যাংক খাতে লুটপাটের কারণে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা চরম বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।
এমন অবস্থার মধ্যে হাইকোর্টের রায়ে সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহাল হলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জন্ম হয়। ১ জুলাই থেকে এই আন্দোলন ঢাকাসহ সারা দেশে তীব্র আকার ধারণ করে। শেখ হাসিনার একটি বিতর্কিত মন্তব্য আন্দোলনের আগুনে ঘি ঢালে। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের প্রতি তাচ্ছিল্য করে তিনি বলেন, “মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিরা কোটা পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতিরা পাবে?”
জুলাইয়ের মাঝামাঝি থেকে আন্দোলন ব্যাপক সহিংসতায় রূপ নেয়। সরকার দমন পীড়নের উদ্দেশ্যে পুলিশের পাশাপাশি ছাত্রলীগ এবং সশস্ত্র দলীয় কর্মীদের মাঠে নামায়। ১৬ জুলাই ঢাকার সায়েন্স ল্যাব এলাকায় সংঘর্ষে নিহত হন দুজন শিক্ষার্থী। রংপুরে পুলিশের গুলিতে আবু সাঈদের মৃত্যুর ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে আন্দোলন আরও বেগবান হয়।
রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে টিয়ার শেল, লাঠিপেটা, এবং নির্বিচার গুলি চালানো হয়। সরকারের নির্দেশে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং আন্দোলনের কেন্দ্রগুলোতে কারফিউ জারি করা হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও আন্দোলন রাজধানী ছাড়িয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
৫ আগস্ট ঘোষণা দেওয়া হয় ছাত্র-জনতার গণভবন অভিমুখে যাত্রার। সেদিন ঢাকার প্রতিটি সড়ক জনস্রোতে ভরে ওঠে। আন্দোলনের চাপে টিকে থাকতে না পেরে শেখ হাসিনা সামরিক বাহিনীর একটি বিমানে করে ভারতে পালিয়ে যান। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে তার দীর্ঘ এক দশকের শাসনের অবসান ঘটে।
৫ আগস্টের পর, আন্দোলনকারীরা গণভবন এবং সংসদ ভবনে প্রবেশ করে। এরপর অস্থায়ী সরকার গঠিত হয়। শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস আন্দোলনকারীদের অনুরোধে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। শেখ হাসিনা সরকারের জুলুম-নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র তখন প্রকাশ হতে শুরু করে।
‘আয়নাঘর’ নামে পরিচিত গোপন বন্দিশালার ভেতর থেকে মুক্তি পান বহু বছর ধরে নিখোঁজ থাকা মানুষজন। গুম এবং বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনায় তদন্ত কমিশন গঠিত হয়, এবং শেখ হাসিনাসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে।
বছরের শেষে, প্রভাবশালী সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট ২০২৪ সালে বাংলাদেশকে “বর্ষসেরা দেশ” হিসেবে ঘোষণা করে। এই স্বীকৃতি স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার আন্দোলন এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের উদাহরণ হিসেবে উল্লেখযোগ্য।
স্বতঃস্ফূর্ত এই গণআন্দোলন নতুন রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ঘটিয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় নাগরিক কমিটি ইতোমধ্যে রাজনৈতিক দল গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। তবে দেশকে নতুন করে গড়ে তোলার পথে রাজনীতিবিদ, নাগরিক সমাজ এবং সাধারণ মানুষের জন্য চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে।
২০২৪ সাল প্রমাণ করেছে যে জনগণের ইচ্ছার সামনে কোনো শক্তিই টিকে থাকতে পারে না। গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচারের স্বপ্ন বাস্তবায়নে এখন নতুন দিনের অপেক্ষা।