গত সাড়ে ১৫ বছরে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতের সর্বনাশের পেছনে কাজ করেছে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এদের নেতৃত্বে ছিলেন পাঁচজন ক্ষমতাধর ব্যক্তি, যারা ‘পঞ্চপাণ্ডব’ নামে পরিচিত। এরা হলেন সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু, প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস, সাবেক এসডিজি সমন্বয়ক আবুল কালাম আজাদ, সামিট গ্রুপের আজিজ খান এবং ব্যবসায়ী এস আলম। এদের পেছনে আরও ছিলেন তিন ‘গডফাদার’—শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানা, পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় এবং শেখ রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব ববি। এদের ছত্রছায়ায় বিদ্যুৎ খাত পরিণত হয়েছিল লুণ্ঠনের মহাউৎসবে। ১. কুইক রেন্টাল: ক্যাপাসিটি চার্জের নামে ১ লাখ কোটি টাকা লুট বিদ্যুৎ খাতের সবচেয়ে বড় দুর্নীতির নাম ‘কুইক রেন্টাল’। কোনো দরপত্র ছাড়াই আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী ও ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। এসব প্রকল্পের বেশিরভাগই কাজে আসেনি, কিন্তু সরকারকে দিতে হয়েছে ‘ক্যাপাসিটি চার্জ’—বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেও সক্ষমতার জন্য অর্থ। গত ১৫ বছরে এ খাতে ব্যয় হয়েছে ৩ লাখ ৩৩ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা, যার মধ্যে শুধু ক্যাপাসিটি চার্জেই লুট হয়েছে ১ লাখ কোটি টাকা। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, মির্জা আজম, ওবায়দুল কাদেরের ভাতিজা, সাবেক মন্ত্রী হাছান মাহমুদসহ ৬৩ জন নেতা-কর্মী কুইক রেন্টালের লাইসেন্স পেয়েছিলেন। অনেক প্রকল্প তিন-চারবার হাতবদল হয়েছে, শুধু কাগজে লেনদেন করে কোটি কোটি টাকা লুটেছে একই গ্রুপ। যেমন, নানকের কেন্দ্র বিক্রি হয় আসলাম হকের কাছে, পরে সিকদার গ্রুপের দখলে যায়। সামিট গ্রুপ পেয়েছে ১০ হাজার ৬২৩ কোটি টাকা, এগ্রিকো ইন্টারন্যাশনাল (ববির পৃষ্ঠপোষকতায়) পেয়েছে ৭ হাজার ৯৩২ কোটি, আর আবুল কালাম আজাদের যোগসাজশে চীনের এরদা পাওয়ার হোল্ডিংস পেয়েছে ৭ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা। ২. ভারতনির্ভরতা: বিদ্যুৎ আমদানিতে কমিশনের খেলা বিদ্যুৎ খাতে স্বনির্ভরতার বদলে ভারতের ওপর নির্ভরতা বাড়ানো হয়েছিল শেখ রেহানার কমিশনের লোভে। আদানি ও রিলায়েন্সের কাছ থেকে বিদ্যুৎ আমদানির নামে গত ৯ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া হয়েছে ১১ হাজার ১৫ কোটি টাকা। ২০১৩ সাল থেকে এ খাতে ভারতের সঙ্গে চুক্তি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে লুটের পরিমাণও। ৩. উৎপাদন ও বিতরণে দুর্নীতি: মিটার থেকে গ্যাসকূপ, সবই লুটের হাতিয়ার বিদ্যুৎ বিতরণ, মিটার স্থাপন, গ্যাসকূপ খননে হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল সিন্ডিকেটের মাধ্যমে। রাশিয়ার গাজপ্রমকে ২০টি গ্যাসকূপ খননের চুক্তি দেওয়া হয়েছিল প্রতিটি ২ কোটি ডলারে, যদিও বাপেক্স ১ কোটি ডলারে এটি করতে পারত। নসরুল হামিদের ভাই অপু, ওবায়দুল কাদেরের ভাতিজা ও কেরানীগঞ্জের শাহীন চেয়ারম্যানের সিন্ডিকেট ৬ হাজার কোটি টাকার মিটারিং প্রকল্প হাতিয়ে নেয়। ৪. রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প: ৫০০ কোটি ডলার আত্মসাৎ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৫০০ কোটি ডলার (৫৯ হাজার কোটি টাকা) আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে শেখ হাসিনা, জয় ও টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে। গ্লোবাল ডিফেন্স কর্পের প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাশিয়ার রোসাটমের সঙ্গে চুক্তির সময় টিউলিপ সিদ্দিক মধ্যস্থতা করেছিলেন, যার বিনিময়ে পাচারকৃত অর্থের ৩০% পেয়েছেন তিনি ও শেখ রেহানা। ‘প্রচ্ছায়া লিমিটেড’ নামে ভুয়া কোম্পানি দিয়ে এ অর্থ পাচার করা হয়। ৫. এলএনজি কেলেঙ্কারি: গ্যাস সংযোগে ঘুষের বাণিজ্য গ্যাস সংযোগ বন্ধ থাকলেও ‘বিশেষ সুপারিশে’ কিছু শিল্প প্রতিষ্ঠান সংযোগ পেত। সাবেক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহীর নেতৃত্বাধীন কমিটি গ্যাস সংযোগে ঘুষ নিতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। নসরুল হামিদের আত্মীয়স্বজন ও ওবায়দুল কাদেরের ভাতিজার সিন্ডিকেট এলএনজি ও এলপিজি প্রকল্পে হাজার কোটি টাকার কাজ নিয়েছে, যার বেশিরভাগই বাস্তবায়িত হয়নি। শেষ কথা: একটি খাতের পতন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতকে লুটের আখড়া বানিয়ে দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। পঞ্চপাণ্ডব ও তিন গডফাদারের এই সিন্ডিকেট রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে টাকা পাচার, ভুয়া প্রকল্প ও কমিশনের রাজত্ব কায়েম করেছিল। এখনও এ লুটের পুরো হিসাব উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি, কিন্তু যতটুকু জানা গেছে, তা দেশের জন্য ভয়াবহ এক অধ্যায়।