নানা উদ্যোগ সত্ত্বেও দ্রুতই চালু হচ্ছে না বহুল প্রতীক্ষিত ঢাকা-নিউইয়র্ক ফ্লাইট। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল এভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (এফএএ) ক্যাটাগরি-১ ছাড়পত্র পাওয়ার প্রক্রিয়া পিছিয়ে যাওয়ায় তা আবার অনিশ্চয়তায় পড়েছে।
এফএএ পরিদর্শকদের মূল্যায়ন অনুযায়ী, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) এখনো ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশনের (আইসিএও) মানদণ্ড অনুযায়ী সুরক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারেনি। তবে এর মধ্যেই নিউইয়র্কসহ আরো ছয়টি গন্তব্যে ফ্লাইট পরিচালনার অনুমতি চেয়ে সম্প্রতি আবেদন করেছে বিমান।আইসিএওর নির্ধারিত মান বাস্তবায়নে ৫০.০৮ শতাংশ থেকে বেড়ে ৭৬ শতাংশ মান অর্জন এবং তৃতীয় টার্মিনালসহ সারা দেশে বিমানবন্দরের অবকাঠামো উন্নয়নের পরও এখনো ক্যাটাগরি-২ থেকে বেরোতে পারেনি বাংলাদেশ। দীর্ঘ ১৮ বছরের দোলাচলে আটকে আছে এই গন্তব্যের ফ্লাইট।সূত্র জানায়, গত বছরের ১৫ থেকে ১৯ অক্টোবর ঢাকায় আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থার (আইকাও) এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সিভিল এভিয়েশন প্রধানদের (ডিজিসিএ) সম্মেলনে অংশ নিয়েছে এফএএর একটি প্রতিনিধিদল। তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের ক্যাটাগরি উন্নয়নের বিষয়টি নিয়ে আলোচনায় তেমন সাড়া মেলেনি।
দ্রুতই হচ্ছে না ক্যাটাগরি উন্নয়ন
নিউইয়র্ক ফ্লাইট চালুর সম্ভাবনার কথা আগেই জানিয়েছিল বেবিচক। গত জুলাই মাসে এক অনুষ্ঠানে বিমান চলাচল খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির তৎকালীন চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মফিদুর রহমান বলেছিলেন, ‘আমরা চেয়েছিলাম ২০২৩ সালের মধ্যে নিউইয়র্কে ফ্লাইট চালু করতে। তবে ফ্লাইটের অনুমতির ক্ষেত্রে এয়ারলাইনস প্রতিষ্ঠানকে আবেদন করতে হয়। বিমান বিলম্বে আবেদন করেছে।এ ছাড়া কভিড মহামারি ক্যাটাগরি-১ অর্জন প্রক্রিয়া পিছিয়েছে।’এভিয়েশনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এফএএর ক্যাটাগরি-১ ছাড়পত্র ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে কোনো দেশের এয়ারলাইনস ফ্লাইট পরিচালনা করতে পারে না। বাংলাদেশ এখন এফএএ ক্যাটাগরি-২-এ আছে, অর্থাৎ বেসামরিক বিমান চলাচলের আন্তর্জাতিক সংস্থা আইসিএওর সব মানদণ্ড পূরণ হয়নি। এ ক্ষেত্রে অন্যতম অন্তরায় হচ্ছে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরকে লেভেল-১ সেফটি রেটিংয়ে উত্তীর্ণ করতে না পারা। এ কারণে দীর্ঘ ১৮ বছর ধরে নিউইয়র্কের সঙ্গে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসসহ অন্য দেশের বিমান সংস্থার ফ্লাইট বন্ধ রয়েছে।ঢাকা-নিউইয়র্ক ফ্লাইট চালুর জন্য তিনটি ধাপ আছে। প্রথমে পরিবহন বিভাগে আবেদন; দ্বিতীয়ত, এফএএর কাছ থেকে ক্যাটাগরি-১ ছাড়পত্র পাওয়া এবং সর্বশেষ যুক্তরাষ্ট্রের পরিবহন নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষের (টিএসএ) ছাড়পত্র প্রাপ্তি।
যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ, ইউনাইটেড এয়ারওয়েজে সরকার নিযুক্ত পরিচালনা পর্ষদের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ টি এম নজরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের নিরাপত্তাজনিত সমস্যা নিয়ে এফএএর এখনো ক্লিয়ারেন্স মেলেনি। আমাদের বিমানবন্দরের অবকাঠামোসহ নানা উন্নয়ন হয়েছে। কার্গোসহ পুরো পরিচালনায় এফএএর শর্ত পূরণ করতে হবে। একটা বাচ্চা ছেলে বিমানবন্দরে ঢুকে প্লেনে উঠে পড়ল—এমন ঘটনা আমাদের নিরাপত্তাব্যবস্থার ত্রুটির কারণেই সম্ভব হয়েছে।’
তিনি বলেন, এফএএর যে অডিট আপত্তিগুলো আছে তা দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে। বিমানকে আবেদন করে বসে থাকলে হবে না, বিভিন্ন পর্যায়ে যোগাযোগ ও নেগোসিয়েশন করতে হবে।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের সাবেক বোর্ড সদস্য কাজী ওয়াহিদুল আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বাংলাদেশ সিভিল এভিয়েশন এফএএর শর্ত পূরণ করতে পারেনি। সে কারণে তারা বাংলাদেশকে এখনো ক্যাটাগরি-২-এ রেখেছে। ওরা বলেছে, সিভিল এভিয়েশনের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন থাকতে হবে। সিভিল এভিয়েশনের কতটুকু স্বায়ত্তশাসন আছে তারা খুব ভালো করেই জানে। আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী, রেগুলেটর ক্যান নট বি অপারেটর, এয়ারপোর্টের জন্য আলাদা কর্তৃপক্ষ থাকতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশে বেবিচকই এয়ারপোর্ট চালায়। সিভিল এভিয়েশন যতক্ষণ পর্যন্ত এফএএর যোগ্যতা অর্জন করতে না পারছে, ততক্ষণ পর্যন্ত বিমান কিংবা অন্য কোনো এয়ারলাইনস যুক্তরাষ্ট্রে ফ্লাইট পরিচালনা করতে পারবে না।’
এই এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘বোয়িংয়ের কাছ থেকে ১০টি উড়োজাহাজ কেনার একটি পূর্বশর্ত ছিল যে তারা আমাদের ক্যাটাগরি উন্নয়নে সহযোগিতা করবে। তারা আমাদের পথ দেখিয়েছে, আমরা সেই পথে চলতে পারিনি। এয়ারবাস থেকে বিমান উড়োজাহাজ কিনলেও ক্যাটাগরি উন্নয়নে কোনো পরোক্ষ প্রভাব পড়বে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশ তো এত দিন বোয়িংয়ের উড়োজাহাজই ব্যবহার করেছে। অনেকে দেশই দুই নির্মাতার উড়োজাহাজ ব্যবহার করছে। এটার সঙ্গে ভূ-রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে।’
যুক্তরাষ্ট্রের ৬ গন্তব্যে ফ্লাইট পরিচালনার আবেদন
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস জানায়, বর্তমানে বিমানের প্রথম অগ্রাধিকার হচ্ছে নিউইয়র্ক ফ্লাইট পরিচালনা করা। তবে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আরো ছয়টি বিমানবন্দরে ফ্লাইট পরিচালনার আবেদন করেছে তারা। সেগুলো হচ্ছে : লস অ্যাঞ্জেলস, ওয়াশিংটন ডিসি, বোস্টন, হিউস্টন, ডালাস ও নিউজার্সি।
উল্লেখ্য, লোকসানের মুখে ২০০৬ সালের ৫ আগস্ট ঢাকা-নিউইয়র্ক রুটে ফ্লাইট বন্ধ করে দেয় বিমান।