শিল্পাঞ্চলে নিরাপত্তা, নীতিমালা সংস্কার এবং সুদের হার কমানোর দাবি জানান ব্যবসায়ীরা। শনিবার ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত ‘বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা পর্যালোচনা এবং ভবিষ্যৎ পথনির্দেশনা’ শীর্ষক সেমিনারে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা এ দাবি জানান।
সেমিনারে এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন, লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাবেক সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর, বিকেএমইএ’র সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম, শাশা ডেনিমস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ডিসিসিআইর সাবেক সভাপতি শামস মাহমুদ, পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ড. মাসরুর রিয়াজ, প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আহসান খান চৌধুরী, মাস্টারকার্ড বাংলাদেশের সৈয়দ মোহাম্মদ কামাল এবং ফুডপান্ডা বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আমব্রারিন রেজা অংশগ্রহণ করেন।
ঢাকা চেম্বারের ঊর্ধ্বতন সহসভাপতি মালিক তালহা ইসমাইল বারী, পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরাসহ বেসরকারি খাতের আমন্ত্রিত অতিথিরা এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
ডিসিসিআই অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত সেমিনারের সূচনা বক্তব্যে ঢাকা চেম্বার সভাপতি আশরাফ আহমেদ বলেন, কোভিড-পরবর্তী সময় থেকে নানাবিধ চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, তবে সাম্প্রতিক সময়ে শিল্প-কারখানায় অসন্তোষের কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, উচ্চমূল্যস্ফীতি ও ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদের হার এবং সাপ্লাই চেইন ব্যবস্থাপনার অস্থিতিশীলতার কারণে বেসরকারি খাত প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, অর্থনীতির সার্বিক বিকাশের লক্ষ্যে যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
তিনি উল্লেখ করেন, দেশের ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট রয়েছে, ফলে উদ্যোক্তারা প্রত্যাশিত মাত্রায় ঋণ পাচ্ছেন না, সেই সঙ্গে কাঁচামাল আমদানিতে ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা শিল্প খাতে পণ্য উৎপাদনকে ব্যাহত করছে, ফলে স্থানীয় চাহিদার জোগান মেটানোর পাশাপাশি রপ্তানি সমন্বিত রাখা বেশ কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তিনি শিল্পাঞ্চলে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সংযোগের জোর দাবি জানান। এ ছাড়া শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে আবাসন, শিক্ষা ও চিকিৎসাসেবা স্বল্পমূল্যে নিশ্চিত করতে সরকারি-বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণেরও দাবি জানান।
মীর নাসির হোসেন বলেন, ১৫ শতাংশের বেশি ব্যাংক ঋণের সুদ দিয়ে ব্যবসা টিকিয়ে রাখা খুবই দুঃসাধ্য, তবে উদ্যোক্তাদের সেটা করতে হচ্ছে। বিশেষ করে কাস্টম হাউজগুলোর দুর্নীতির কারণে ব্যবসায়ীরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, যেটি নিরসনে সরকারের পক্ষ থেকে ফিন্যান্সিয়াল রিফর্মস কমিটি গঠন করার পাশাপাশি অটোমেশন নিশ্চিত করা জরুরি।
সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে ব্যবসায়ীরা ভীষণভাবে অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে রয়েছে, যা উত্তরণে শিল্পাঞ্চল বিশেষ করে শিল্পপুলিশ ও সেনাবাহিনীর কার্যক্রম আরও জোরদার করতে হবে, পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে হবে।
মোহাম্মদ হাতেম বলেন, বিদ্যমান শ্রমিক অসন্তোষ কার্যক্রমে অনুপ্রবেশকারীদের হাত রয়েছে এবং এ অবস্থা উত্তরণে শ্রমিক-মালিক ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মধ্যকার সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় করতে হবে।
তিনি বলেন, ইতোমধ্যে শ্রমিকদের বেশকিছু দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে, পাশাপাশি শ্রমিকদের যেকোনো যৌক্তিক দাবি বিজেএমইএ ও বিকেএমইএ ইতিবাচকভাবে মেটাতে বদ্ধপরিকর। সেই সঙ্গে বৈশ্বিক ব্র্যান্ড ও ক্রেতা প্রতিষ্ঠান থেকে পণ্যের যৌক্তিক মূল্য পাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। এ মুহূর্তে স্থানীয় উদ্যোক্তার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দিচ্ছি। খেলাপি ঋণ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ সিদ্ধান্তের কারণে দেশের অধিকাংশ উদ্যোক্তা খেলাপি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, যা পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন।
শামস মাহমুদ বলেন, বিচার বিভাগ, এনবিআর এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যক্রমে বেশকিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ পরিলক্ষিত হয়েছে, যা আশাব্যঞ্জক। তবে বর্তমান সময়ে তৈরি পোশাক খাতের ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ, শ্রমিক ইউনিয়নের নেতৃত্ব ও শ্রমিক অসন্তোষের কারণে শিল্প-কারখানায় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ায় পণ্য উৎপাদন কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে, যা মোটেও কাম্য নয়, যে কোনো মূল্যে এ পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটাতে হবে, তা না হলে বাংলাদেশ বৈশ্বিকভাবে ইমেজ সংকটে পড়তে পারে।
ড. মাসরুর রিয়াজ বলেন, দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির সমস্যা সমাধানে আমরা গত দুই বছরে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়েছি, যার প্রভাব বর্তমান সময়ে পরিলক্ষিত হচ্ছে এবং ব্যবসায়ীদের আস্থার পরিবেশ উন্নয়নে দ্রুত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। মাসরুর রিয়াজ বলেন, ঋণপত্র খোলাসহ আর্থিক খাতের অন্যান্য সমস্যা সমাধানে রিজার্ভে আরও ৬-৮ বিলিয়ন ডলারের সংযোজন ঘটাতে হবে।
আহসান খান চৌধুরী বলেন, শ্রমিক অসন্তোষ, জ্বালানি স্বল্পতা, ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদের হারসহ নানাবিধ সমস্যা বেসরকারি খাতকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে, যা দ্রুততম সময়ে উন্নতি করতে হবে। তিনি বলেন, শিল্প খাতে সব ধরনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে, অন্যথায় কর্মসংস্থানের সুযোগ হ্রাস পাবে। আহসান খান আরও বলেন, বিদ্যমান ঋণের উচ্চ সুদের হার দিয়ে ব্যবসায়িক কার্যক্রম অব্যাহত রাখা খুবই কঠিন এবং সুদের হার কমাতে সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে। এছাড়া ঋণখেলাপি সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
সৈয়দ মোহাম্মদ কামাল বলেন, চলতি বছরের জুলাই, আগস্ট মাসে ডিজিটাল পেমেন্ট কার্যক্রম বেশ হ্রাস পেলেও সাম্প্রতিক সময়ে কিছুটা বেড়েছে, তবে গত মাসের বন্যা ও পার্বত্য এলাকায় অস্থিরতার ফলে স্থানীয় পর্যটন ব্যবসা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে।
আমব্রারিন রেজা বলেন, গত ৩ মাসে ইন্টারনেট সেবা বিঘ্নিত হওয়ায় বিশেষ করে ডিজিটাল সেবা খাতের ব্যবসায়ীরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এবং এ খাতের অধিকাংশ উদ্যোক্তাই এসএমই, যাদের ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড স্বাভাবিক করতে দ্রুততম সময়ে স্বল্পসুদে ঋণ সুবিধা প্রদান করা জরুরি।এ ছাড়া সারা দেশে ডিজিটাল সেবা খাতের সম্প্রসারণে ইন্টারনেট প্রাপ্তির খরচ হ্রাস করা প্রয়োজন।