বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো তিন দশকের মধ্যে প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি বন্ডের তুলনায় বেশি স্বর্ণ মজুদ করছে। এতদিন ধরে অনেক দেশ তাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রাখতে মার্কিন ডলার, ইউরো ও ট্রেজারি বন্ডে নির্ভর করত, আর কিছু পরিমাণ স্বর্ণ ছিল সঙ্গী। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ওই চিত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ‘ইন্টারন্যাশনাল রোল অফ দ্য ইউরো ২০২৫’ রিপোর্ট অনুযায়ী, বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর হাতে ৩৬ হাজার টনের বেশি স্বর্ণ রয়েছে, যার বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ৩.৬ ট্রিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে, মার্কিন ট্রেজারি বন্ডের পরিমাণ ৩.৮ ট্রিলিয়ন ডলার, যা কমবেশি সমান। এই পরিবর্তনের পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে স্বর্ণের দাম রেকর্ড পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২৫ সালে স্বর্ণের দাম প্রতি আউন্সে ৩,৫০০ ডলারের ওপরে উঠেছে, যা বেশিরভাগ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, তিনটি প্রধান কারণেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো এখন স্বর্ণের দিকে ঝুঁকছে। প্রথমত, স্বর্ণ এমন একটি সম্পদ যা জব্দ বা স্থগিত করা যায় না। ২০২২ সালে রাশিয়ার ডলার এবং ইউরো রিজার্ভ অবরুদ্ধ হওয়ার পর, বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ স্যাংকশন-প্রুফ সম্পদের সন্ধানে বের হয়েছে। দ্বিতীয়ত, মার্কিন সরকারের ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে, অনেক দেশ মার্কিন বন্ডে অতিরিক্ত নির্ভর করতে চাচ্ছে না। তৃতীয়ত, বৈচিত্র্যময় রিজার্ভের কৌশল হিসেবে স্বর্ণের গুরুত্ব আরও বেড়েছে। ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো মোট ১,০৮২ টন, ২০২৩ সালে ১,০৩৭ টন এবং ২০২৪ সালে ১,০৪৫ টন স্বর্ণ কিনেছে—যা এক দশক আগের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি। ২০২৫ সালের প্রথমার্ধে এ পরিমাণ প্রায় ৪১০ টনে পৌঁছেছে, এবং বছরের শেষে এটি প্রায় ১,০০০ টনে পৌঁছানোর সম্ভাবনা রয়েছে, বলে জানিয়েছেন লন্ডনের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান মেটালস ফোকাস। এদিকে, সাম্প্রতিক এক সমীক্ষা অনুযায়ী, ৪৩ শতাংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংক আগামী বছরে আরও স্বর্ণ কেনার পরিকল্পনা করছে, এবং ৯৫ শতাংশ মনে করছে বিশ্বব্যাপী স্বর্ণের মজুদ আরও বাড়বে। ভারতও এই প্রবণতার অংশ। ২০২৫ সালের মার্চে ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংকের হাতে ছিল প্রায় ৮৮০ টন স্বর্ণ, যা দেশটির মোট রিজার্ভের প্রায় ১২ শতাংশ। এই পদক্ষেপ রুপির প্রতি আস্থা বাড়াতে সাহায্য করছে। তবে, স্বর্ণের দাম বাড়ায় দেশের ভেতরে ঐতিহ্যগতভাবে শক্তিশালী স্বর্ণের চাহিদা বাড়ানোর ফলে একটি নতুন দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে। এই পরিবর্তনের মাধ্যমে বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো প্রমাণ করেছে যে, স্বর্ণ এখন শুধু একটি মুদ্রা নয়, বরং একটি গুরুত্বপূর্ণ সুরক্ষা ও বৈচিত্র্যময় সম্পদ হিসেবেও প্রাধান্য পাচ্ছে।