আজ ১৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৩০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

সময় : সকাল ৭:৩৫

বার : মঙ্গলবার

ঋতু : গ্রীষ্মকাল

বাংলাদেশে পরিবর্তন কি আসন্ন?

বাংলাদেশে পরিবর্তন কি আসন্ন?

একটি ফ্যাসিস্ট শাসন ব্যবস্থায় দিনক্ষণ ঘোষণা করে পরিবর্তন আসে না। যে দেশে গণতান্ত্রিকভাবে সরকার পরিবর্তনের কোন সুযোগ থাকে না সে দেশে প্রায় সর্বদা আকস্মিকভাবেই সরকারের পতন ঘটে। যেমন, ১৯৭৫ সালে ১৪ আগস্ট মধ্যরাতেও বাংলাদেশের জনগণ জানত না যে, কয়েক ঘন্টার মধ্যেই আওয়ামী জাতির পিতা শেখ মুজিবের বাকশালি একনায়কতন্ত্রের পতন ঘটতে চলেছে। ১৯৯০ সালেও গণঅভ্যুত্থানের মুখে জেনারেল এরশাদের আকস্মিক পতনই হয়েছিল। অবশ্য দুই স্বৈরাচারের পতনের ক্ষেত্রেই সেনাবাহিনীর বিশেষ ভূমিকা ছিল।

১৯৭১ সালে রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা (আমাদের দেশে আবার দুগ্ধপোষ্য শিশু থেকে শুরু করে যুদ্ধ না করেই নানান কিসিমের মুক্তিযোদ্ধার বিশাল গোষ্ঠী আছে) সেনা অফিসারদের একাংশের নেতৃত্বে ১৯৭৫ সালের সামরিক অভ্যুত্থানে শেখ মুজিব নিহত হয়েছিলেন। সেই দেশপ্রেমিক অফিসাররা শেখ মুজিবের দু:শাসন আর সহ্য করতে না পেরে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন। আর ১৯৯০ সালে তৎকালিন সেনাপ্রধান জেনারেল নুরউদ্দিন সেনাবাহিনীর আনুগত্য হারানোর কথা এরশাদকে জানিয়ে দিলে স্বৈরাচারের পতন নিশ্চিত হয়ে গেছিল। জনবিচ্ছিন্ন প্রেসিডেন্ট এরশাদ চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। বাংলাদেশের জনগণের দূর্ভাগ্য যে, শেখ মুজিব এবং এরশাদের চাইতে বহুগুন নির্মম ও ভয়ানক, দিল্লির এজেন্ট এক ফ্যাসিস্ট শাসক, চৌদ্দ বছর ধরে তাদের উপর অবর্ণনীয় জুলুম চালিয়ে যেতে পারছে। ২০১৩, ২০১৪, এবং ২০১৫ সালে সরকারবিরোধী আন্দোলন দেশব্যাপী তীব্র রূপ নিলেও প্রধানত ভূরাজনৈতিক কারণে এবং খানিকটা বিরোধী দলের কৌশলগত ভুলের ফলে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যূত করা সম্ভব হয় নাই। সেই সুযোগ গ্রহণ করে শেখ হাসিনা ক্রমেই আরো বেপরোয়া ও রক্তলোলুপ হয়েছেন, তার নির্দেশে আওয়ামী পুলিশ জনগণের উপর নির্যাতনের মাত্রা বহুলাংশে বৃদ্ধি করেছে। অবশেষে ২০২২ সালে এসে হাসিনার অপশাসনে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মজলুম জনগণের মধ্যে পরিবর্তনের আকাঙ্খা জোরদার হয়েছে। অনেকে বলতে শুরু করেছেন ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন অতি শীঘ্রই। তাদের আশাবাদের ভিত্তি খানিকটা পর্যালোচনা করা যাক।

গত দুই বছরে দক্ষিণ এশিয়ায় ভূরাজনীতির নাটকীয় পরিবর্তন হয়েছে। তথাকথিত ‘ইসলামী জঙ্গীবাদের’ বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট বুশের ‘অনন্ত যুদ্ধের’ নীতি থেকে প্রেসিডেন্ট বাইডেন সরে আসায় দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের একচ্ছত্র দাদাগিরির অবসান ঘটেছে। তার উপর ২০২০ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কূটনৈতিক শিষ্টাচার জলাঞ্জলি দিয়ে ট্রাম্পের পক্ষে মোদির প্রকাশ্য প্রচারণার ফলে ওয়াশিংটনে ভারতীয় লবির প্রভাব কিছুটা হলেও কমেছে। অপরদিকে পাকিস্তানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কেরও দৃশ্যমান উন্নতি হয়েছে। ভারত অসন্তুষ্ট হলেও পাকিস্তান সেনাবাহিনী আবারও মার্কিন অস্ত্রশস্ত্র পাচ্ছে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হাসিনাও তার মনিব মোদিকে অনুসরণ করে ট্রাম্পের পক্ষেই বাজি ধরেছিলেন। তাছাড়া, ২০১৬ সালে ডেমোক্রেট দলীয় প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিলারি ক্লিন্টনের প্রতি শেখ হাসিনার প্রবল ব্যক্তিগত বিরাগের কথাও সবাই জানেন। হাসিনাপুত্র জয় মার্কিন মুলুকে থেকেও হিলারি ক্লিন্টনের বিরুদ্ধে যে ভাষায় সিরিজ টুইট করেছেন এবং ফেসবুকে স্টেটাস দিয়েছেন সেগুলো কূটনৈতিক শিষ্টাচারের মধ্যে পড়ে না। ২০২০ সালে ট্রাম্প নির্বাচনে জিততে পারলে শেখ হাসিনাকে হয়ত মার্কিন স্যাংকশনের মুখে পড়তে হতো না। ইসলামোফোবিক এবং বর্ণবিদ্বেষী ট্রাম্পের বিশ্বে মানবাধিকার নিয়ে কোন মাথাব্যথা ছিল না। এই মাসের প্রথম দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যবর্তী নির্বাচনে ডেমোক্রেট দলের সাফল্য প্রেসিডেন্ট বাইডেনের রাজনৈতিক অবস্থান অধিকতর শক্তিশালী করেছে। নির্বাচনে ডেমোক্রেটরা হারলে বাইডেনের দুর্বল (Lame-Duck) প্রেসিডেন্টে পরিণত হওয়ার আশংকা ছিল। এবারও হাসিনা এবং মোদি রিপাবলিকানদের জয়লাভের আশায় ছিলেন। সব মিলে ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি বাংলাদেশের ফ্যাসিস্ট শাসকের বিরুদ্ধে চলে গেছে বলা যেতে পারে।

২০১৮ সালের নিশিরাতে পুলিশ দিয়ে ভোটের বাক্স ভর্তি করার নির্বাচনে হাসিনা যে পাঁচ বছরের সর্বশেষ বিতর্কিত ম্যান্ডেট জোর করে আদায় করেছিল তার মেয়াদেরও আর মাত্র বছর খানেক বাকি রয়েছে। আন্তর্জাতিক মহল ইতোমধ্যে তাকে প্রকাশ্যেই বুঝিয়ে দিয়েছে যে, ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের মত নির্বাচনের নামে তামাশা করে ক্ষমতায় আর টিকে থাকা যাবে না। গত সপ্তাহে জাপানী রাষ্ট্রদূতের ২০১৮ নিয়ে বক্তব্যের পর এ বিষয়ে হাসিনা ও তার দালালদের মনে আর কোন সন্দেহ থাকা উচিৎ নয়। প্রথমে রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রির সফর বাতিল এবং তারপর শেখ হাসিনার জাপান সফর স্থগিত হওয়ার ঘটনায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকারের বিচ্ছিন্নতাকেই প্রকট করেছে। তার উপর ভারত এবং চীনের সাথে সম্পর্ককে কেন্দ্র করে শেখ হাসিনার শ্যাম রাখি না কুল রাখি দোদুল্যমানতা ফ্যাসিস্ট শাসনকে ক্রমেই দুর্বল করে ফেলছে। এই অবস্থায় ওয়াশিংটন থেকে শেখ হাসিনার অবৈধ, ফ্যাসিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে কোন চূড়ান্ত, কড়া বার্তা এলে তাকে ঠেকানোর ইচ্ছা বা সাধ্য দিল্লির কতটা থাকবে সেটা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে।

এদিকে দেশের অভ্যন্তরে অর্থনেতিক ধ্বস এবং জনগণের প্রবল বিক্ষোভের মিলিত চ্যালেঞ্জ হেফাজতের ম্যাসাকারের মত নিরস্ত্র ও শান্তিপূর্ণ জনতার উপর গুলি চালিয়ে মোকাবেলা করার ক্ষমতা শেখ হাসিনা হারিয়ে ফেলেছেন। গত ডিসেম্বরে মার্কিন স্যাংকশনপ্রাপ্ত পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাদের পুরষ্কৃত করে খুনিদের নৈতিক শক্তি ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালানো হলেও অন্যান্য পুলিশ কর্মকর্তারা সিগনাল পেয়ে গেছেন যে, দেশের নাগরিকদের গুমখুন করে এবং বিচারবহির্ভূত হত্যা চালিয়ে নিশ্চিন্তে বিলাসিতাপূর্ণ কর্মজীবন ও অবসর জীবন কাটানো যাবে না। একের পর এক ইসলামী জঙ্গী কার্ড খেলার চেষ্টাও আন্তর্জাতিক মহলকে যারপরনাই বিব্রত এবং বিরক্ত করছে। অভিজিৎ এবং অন্যান্য ব্লগারদের যে হাসিনার নির্দেশক্রমে গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনই হত্যা করেছে সেই সন্দেহ আন্তর্জাতিক মহলে ক্রমেই প্রবল হচ্ছে। এই সব মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। এমন সার্বিক সঙ্গীন অবস্থায় শেখ হাসিনা খুনের নির্দেশ দেবেন আর অতীতের বেনজিরদের মত পুলিশের বর্তমান কর্মকর্তারা দেশের নাগরিকদের উপর নির্বিচারে গুলি চালাবেন, হাসিনার এই প্রত্যাশা পূর্ণ হওয়ার সম্ভাবনা আমি দেখছি না। হাসিনা অবশ্য বলে রেখেছেন যে, তিনি হেফাজতের মতই বিএনপি’র আন্দোলনকেও ঠান্ডা করবেন। বাস্তবতা হলো, ২০১৩ সালের সেই ক্ষমতা দেখানোর মত পরিস্থিতি ও সময় কোনটাই তার হাতে নাই।

আজকের সম্পাদকীয়র মূল প্রশ্নে আবার ফিরে আসি। অনেকেই বলা শুরু করেছেন যে ১০ ডিসেম্বর একটা চূড়ান্ত কিছু ঘটে যাবে। হাসিনার পতনের জন্য আমি কিন্তু, কোন দিনক্ষণ দেখছি না। আমি মনে করি ভূরাজনীতি, অর্থনীতি এবং অভ্যন্তরীণ রাজনীতির সকল বিবেচনাতেই শেখ হাসিনা অবশ্যম্ভাবী পতনের সম্মুখীন। সেই পতনের তারিখ ১০ ডিসেম্বরের পূর্বে হলেও আমি বিস্মিত হব না। আবার ১০ ডিসেম্বরের ধারাবাহিকতায় কয়েক সপ্তাহ পরেও ফ্যাসিস্ট সরকার ধ্বসে পড়তে পারে। মহান আল্লাহতায়ালার কাছে কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করি যাতে তিনি আমাদের বিজয়ের মাস ডিসেম্বরেই ফ্যাসিস্ট শাসনকে কবর দিয়ে দ্বিতীয় বিজয় দিবস পালনের সুযোগ করে দেন। এবারের বিজয়ের আনন্দ ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের চেয়ে কোন অংশে কম হবে না সেটা জোরের সাথেই বলতে পারি। ১৯৭৫ এবং ১৯৯০ সালে যথাক্রমে মুজিবীয় একনায়কতন্ত্র ও এরশাদীয় স্বৈরাচারের পতন হয়েছিল। এবার হাসিনার ফ্যাসিবাদের দাফন হোক। আর কোন স্বৈরাচার কিংবা ফ্যাসিবাদ বাংলাদেশে যেন ভবিষ্যতে জন্ম না নেয়। আসুন সমস্বরে বলি, Never Again। 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     More News Of This Category