শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:৪১ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম :
আলাল খালেদা জিয়ার সেনানিবাসের বাড়ি ফেরতের দাবি জানালেন বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনা হলের নাম পরিবর্তন কুবিতে নতুন রাজনৈতিক দল আসা প্রয়োজন ছাত্র-জনতার সমন্বয়ে: সারজিস আপিল শুনানি শেষ, রায় যেকোনো দিন : ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা কেনিয়ার চুক্তি বাতিল যুক্তরাষ্ট্রে আদানির বিরুদ্ধে পরোয়ানার পর, বাংলাদেশ কী করবে? মোহিনীর সঙ্গে প্রেমের গুঞ্জন,এআর রহমানের বিচ্ছেদ; কি বলছেন পুত্র-কন্যা? শেয়ারে ‘ধস’ গৌতম আদানির বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে মামলার পরেই বোমা হামলার পরিকল্পনা নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জে: ফ্লোরিডায় গৃহহীন ব্যক্তি গ্রেফতার বিতর্কিত আউট নিয়ে প্রশ্ন আর সমালোচনার ঝড় রাহুলের যেভাবে ফ্রিজে রাখা যায় রসুন

‘দুর্যোগ’ পোশাক খাতে :পাশের দেশে যাচ্ছে কার্যাদেশ!

bornomalanews
  • Update Time : রবিবার, ৬ অক্টোবর, ২০২৪
  • ৩৭ Time View

রপ্তানিমুখী পোশাক তৈরির কোম্পানি এসরোটেক্স গ্রুপের পাঁচটি কারখানা মিলে গেল সপ্তাহে লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ১৯ শতাংশ উৎপাদন করতে পেরেছে। আগামী তিন মাসের জন্য যে ক্রয়াদেশ তাদের হাতে আছে, তাও উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে না শ্রমিক বিক্ষোভের কারণে।

এসরোটেক্সে গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসাদুল ইসলাম অসহায় ভঙ্গিতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বললেন, অবস্থা এমন চললে কারখানাগুলো পুরোপুরি বন্ধের কথা ভাবতে হবে তাদের।

“শ্রমিকরা কথা শোনে না। তাদের কথায় আমাদের চলতে হচ্ছে। তিনদিন লে অফ ঘোষণা করেছি। শ্রমিকরা সেসব দিনের পারিশ্রমিকও চাইছে।”

শ্রমিকদের এমন দাবিকে ‘দিনে দুপুরে ডাকাতি’ বলছেন আসাদুল ইসলাম।

প্রায় ২১ হাজার শ্রমিক নিয়ে কাজ চালিয়ে আসা এসরোটেক্সের পাঁচ কারখানা মিলে প্রতি মাসে দেড় কোটি থেকে এক কোটি ৬০ লাখ ডলারের পোশাক রপ্তানি করে। কিন্তু শ্রমিকরা সেপ্টেম্বরে ২৬ কর্মদিবসের কাজ করেছেন মাত্র ১৬ দিন।

ব্যাংক ঋণ নিয়ে শ্রমিকদের বেতন দিতে হচ্ছে জানিয়ে আসাদুল বলেন, “এভাবে কতদিন তারা ঋণ দেবে। চিন্তা করছি, কারখানা বন্ধ করে দেব। এভাবে চলতে থাকলে তো আর কোনো উপায় নেই।”

শুধু এসরোটেক্সেই না, শ্রমিক অসন্তোষের ধাক্কায় এ খাতের বহু বড় কোম্পানির একই দশা। ক্ষমতার পালাবদলে আইনশৃঙ্খলার অবনতির মাঝে পোশাক খাতের শ্রমিকদের অসন্তোষ, আন্দোলন, কর্মবিরতি এবং একের পর এক কারখানা বন্ধের ঘটনায় রপ্তানি আয়ে ৮৫ শতাংশের মত অবদান রাখা এ খাতের ভবিষ্যৎ নিয়ে নানামুখী শঙ্কা দানা বাঁধছে।

উৎপাদন তলানীতে নেমে যাওয়া, কার্যাদেশ পাশের দেশে চলে যাওয়া, আয় কমে ব্যাংক ঋণে নির্ভরশীলতার পাশাপাশি সামনের দিনে বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে দেশের রপ্তানিতে অবদান রাখা অনেক বড় কোম্পানির।

দেশে প্রায় ২ হাজার ৮০০ পোশাক কারখানা আছে, যারা সরাসরি পোশাক রপ্তানির সঙ্গে জড়িত।

অব‍্যাহত শ্রমিক অসন্তোষ ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে ১২ সেপ্টেম্বর কেবল আশুলিয়ার শিল্পাঞ্চলের ৮৬টি কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন‍্য বন্ধ ও ১৩৩টি কারখানায় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ।

একই দিন এক সংবাদ সম্মেলনে সরকারের তরফে জানানো হয়, ৫০টির বেশি কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। প্রতিদিনই বহু কারখানা বন্ধ থাকছে। তাতে পোশাকের কার্যাদেশ বাতিল হয়ে যাচ্ছে।

শ্রমিক অসন্তোষ ঠেকাতে প্রায়ই সেনাবাহিনীর সহায়তা নিতে হচ্ছে। ফাইল ছবি

শ্রমিক অসন্তোষ ঠেকাতে প্রায়ই সেনাবাহিনীর সহায়তা নিতে হচ্ছে। ফাইল ছবি

সরকারের ভাষ্যে ২০% কার্যাদেশ ‘বাতিল’

শ্রমিক অসন্তোষের প্রেক্ষিতে প্রায় ১৫ থেকে ২০ শতাংশ কার্যাদেশ বাতিল হয়ে গেছে বলে গত ১২ সেপ্টেম্বরের সংবাদ সম্মেলনে জানান শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।

তবে এসরোটেক্স গ্রুপের এমডি আসাদুল ইসলামের ভাষ্য, কার্যাদেশ কমে যাওয়ার চেয়েও বড় শঙ্কা অপেক্ষা করছে সামনের দিনে। তার ভাষায়, “এভাবে চলতে থাকলে ইন্ডাস্ট্রিই চলবে না।”

একই সুরে কথা বললেন স্প্যারো গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শোভন ইসলামের। পৃথিবীর ২০টি দেশের ৪০টি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানকে পোশাক রপ্তানি করে এই গ্রুপ।

শোভন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ক্রেতারা সাধারণত এমন সমস্যা হলে ভাবেন ৪-৫ দিনেই সমাধান হবে। বেশি গেলে ৭ দিনে হবে। অথচ মাস পেরিয়ে গেছে, কোনো সমাধান হয়নি। আমরা শ্রমিকদের ১৮ দফা মেনেছিলাম। কিন্তু দিন দিন দফা বাড়ছেই। খুবই হতাশাজনক।”

এমন চলতে থাকলে ‘অস্তিত্ব সংকট’ তৈরি হবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “সত্যি বলতে ওভারনাইট ক্রয়াদেশ পড়ে না। অর্ডার তিনমাস আগেই বুকিং দেওয়া থাকে। কিন্তু আমরা উৎপাদন করতে পারছি না। অর্ডার এক্সিকিউট না করা গেলে অর্ডার পেয়েই বা কী!

“১০-২০ শতাংশ অর্ডারের বিষয়ে ক্রেতারা বলছেন, এখন আর তাদের দরকার নেই। ক্রেতারা নতুন করে নেগোশিয়েট করছেন না।”

শ্রমিক অসন্তোষ প্রথমে আশুলিয়াতে থাকলেও দেশের বিভিন্ন জায়গায় সেটা ‘ছড়িয়ে যাচ্ছে’ বলে জানান শোভন।

রপ্তানিকারকরা বলছেন, বিদেশি ক্রেতাদের মধ্যে যে আস্থার সংকট তৈরি হল, সেটাই সবচেয়ে বড় ক্ষতি।

রপ্তানিকারকরা বলছেন, বিদেশি ক্রেতাদের মধ্যে যে আস্থার সংকট তৈরি হল, সেটাই সবচেয়ে বড় ক্ষতি।

ক্রয়াদেশ অন্যান্য দেশে

চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই ভালো যাচ্ছে না বাংলাদেশের। জুলাই জুড়ে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে নৈরাজ্য, সহিংসতা আর সংঘাতের পর কারফিউ জারি হয়। প্রথমবারের মত দীর্ঘ সময়ের জন্য ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউটের কবলে পড়ে সারা পৃথিবীর সঙ্গে দেশের বাণিজ্য যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এতে বিশ্ব বাজারে তৈরি হয় ‘আস্থার সংকট’।

আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুৎ হলে হাল ধরেন মুহাম্মদ ইউনূস। পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে তার ভালো সম্পর্ক থাকায় আশার আলো দেখেছিলেন পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরা। তবে আশার প্রদীপ নিভে যায় ক্ষমতার পালাবদলের পর আইনশৃঙ্খলার অবনতি হলে।

বিভিন্ন শিল্প কারখানায় হামলা হয়। ঝুট ব্যবসার দখলদারিত্ব ও চাঁদাবাজি নিয়ে এ খাতে ফের অস্থিরতা তৈরি হয়। আর শ্রমিক অসন্তোষ যেন কফিনে ‘শেষ পেরেক’ ঠোকে। প্রতিযোগিতামূলক দেশগুলো এ সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে বা ক্রেতারাও তাদের দিকে ঝুঁকছে।

এ খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি রফিকুল ইসলাম বলছেন, ৩০ শতাংশের মত কার্যাদেশ অন্যান্য দেশে চলে গেছে।

স্প্যারো গ্রুপের শোভনও একই কথা বলেছেন। তার ভাষ্য, “যখন ক্রেতারা বলছেন এখন আর লাগবে না। আমরা বুঝি তারা অন্য দেশে এ কার্যাদেশ দিয়েছেন।”

এক কোটি ৭০ লাখ পোশাকের একটি কার্যাদেশ হাতছাড়া হওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “প্রতিটি পোশাকের মূল্য ৪ ডলার করে হলেও সবগুলোর মূল্য কত হয় তা হিসাব করে দেখুন। এ আদেশটি ২-৩টি কোম্পানি মিলে পেত। দ্য এন্টায়ার অর্ডার হ্যাভ অলরেডি মুভড।”

উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হাতছাড়া হওয়া কার্যাদেশগুলো বাংলাদেশের প্রতিযোগী দেশ ভারত, ভিয়েতনাম, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া এবং পাকিস্তানে যাচ্ছে।

কার্যাদেশ বাতিল হওয়ার বিষয়টি ১২ সেপ্টেম্বরের হওয়া সংবাদ সম্মেলনে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদও বলেছেন।

ওইদিন তিনি বলেন, “আমরা ইতোমধ্যে এমন কিছু তথ্য পেয়েছি যেটা ওই বিষয়টিই ইঙ্গিত করে। এটা একটি সিজনাল বিজনেস। মার্কেটে যে প্রোডাক্ট যাবে সেটা তিন মাস আগেই প্রস্তুত করতে হয়। সেই অর্ডারগুলো অনেক জায়গায় বাতিল হয়ে যাচ্ছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি কিছু নির্দিষ্ট দেশের ব্যবসায়ীরা অর্ডারটা নেওয়ার জন্য লবিং করছে, উঠে পড়ে লেগেছে।”

শ্রমিক অসন্তোষের মধ্যেও কিছু কারখানা চালু থাকলেও আশানুরূপ উৎপাদন করতে পারছে না। ফাইল ছবি।

শ্রমিক অসন্তোষের মধ্যেও কিছু কারখানা চালু থাকলেও আশানুরূপ উৎপাদন করতে পারছে না। ফাইল ছবি।

রপ্তানি কত কমবে?

আশুলিয়ার বড় একজন পোশাক রপ্তানিকারক বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের এক কোম্পানি প্রতিবছর তাদের ১ কোটি পোশাকের আদেশ দিত।

কিন্তু সেই ক্রেতা এখন অন্য দেশে ‘চলে যাচ্ছে’ জানিয়ে তিনি বলেন, আশুলিয়াকে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা ‘রিস্কি জোন’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

সুরমা গার্মেন্টস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফয়সাল সামাদ বলেন, বারবার শ্রমিক আন্দোলনে কারখানা বন্ধের জেরে ৯০০ কোটি টাকার মত ক্ষতি হচ্ছে তাদের।

ক্ষতির মুখে পড়েছে অনন্ত গার্মেন্টসও। কারখানা বন্ধের কারণে পণ্য জাহাজীকরণের (শিপিং) সময় ফসকে যাওয়ায় তাদের প্রায় ১০ লাখ পোশাক আটকে (ব্যাকলগ) গেছে। এখন আকাশপথে বিপুল অর্থ ব্যয়ে তাদের পণ্য পাঠাতে হবে।

যেহেতু উৎপাদন ব্যহত হচ্ছে, কার্যাদেশ বাতিল হচ্ছে, শিপমেন্ট সঠিক সময়ে করা যাচ্ছে না, এর প্রভাব পড়ছে সরাসরি রপ্তানি আয়ে। এখনকার চেয়েও বেশি ভাটার শঙ্কা দেখা যাচ্ছে চলতি অর্থবছরের তৃতীয় প্রান্তিকে।

বাংলাদেশ ২০২২-২৩ অর্থবছরে রপ্তানি থেকে আয় করে ৫ হাজার ৫৫৫ কোটি ডলার। এর মধ্যে পোশাক রপ্তানি থেকেই আসে ৪ হাজার ৬৯৯ কোটি ডলার, যা মোট রপ্তানি আয়ের ৮৪ দশমিক ৫৮ শতাংশ।

পোশাক খাতের সবচেয়ে রমরমা সময় যায় জানুয়ারি-মার্চ সময়ে। ওই সময়টায় যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপসহ পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলোতে ছুটি ও ভ্রমণের আমেজ থাকায় তখন বাংলাদেশের পণ্যের বিক্রি বাড়ে।

ওই সময়ের পণ্যের কার্যাদেশ পেতে নমুনা পাঠাতে হয় অগাস্টের ছুটির আগে। কিন্তু দেশে জুলাই থেকে শুরু হওয়া অস্থিরতা ঘিরে কারখানা বন্ধ, আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম বন্ধ থাকা ও ইন্টারনেট ব্ল্যাক আউটের কবলে পড়ে অনেকেই নমুনা পাঠাতে সমস্যায় পড়েছেন বা পিছিয়ে পড়েছেন।

রপ্তানিকারকরা বলছেন, ইন্টারনেট ও যোগাযোগ বন্ধ থাকায় বিদেশি ক্রেতাদের মধ্যে ‘আস্থার’ যে সংকট প্রথমে হয়েছিল, তার মাশুল এমনিতেই গুনতেই হত। এখন শ্রমিক অসন্তোষের কারণে অচলায়তন তৈরি হল।

এর জেরে জানুয়ারি-মার্চ সময়ে ৬০০ কোটি (৬ বিলিয়ন) ডলার পর্যন্ত রপ্তানি কমে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন শোভন ইসলাম।

তাছাড়া রপ্তানিকারকরা যে ৩০ শতাংশ কার্যাদেশ বাতিলের কথা বলছেন, তাতেও একই পরিমাণ রপ্তানি কমার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। সঙ্গে চলতি কার্যাদেশের উৎপাদন ও রপ্তানি সঠিক সময়ে না করা গেলে এর পরিমাণ আরও বাড়বে।

অসন্তোষের শুরু যেভাবে

গাজীপুর ও আশুলিয়াসহ বিভিন্ন স্থানে শ্রমিক অসন্তোষের মধ্যে ২৩ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় সংগঠনের উত্তরা কার্যালয়ে ‘বিশেষ সাধারণ সভায় বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি রেদওয়ান আহমেদ বলেন, সমস্যার শুরু হয়েছিল নাসা গ্রুপ থেকে।

নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ‘হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট’ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

রেদোয়ান বলেন, “শ্রমিকদের বেতন না দিয়ে শ্রম অসন্তোষ তৈরি করছেন তারা। সমস্যা তো সামলানো গেছিল, শুরুতেই ওখানে হাত দিলে এত বড় হত না। এখন নজরুলরা কোটি কোটি টাকা ঢালছেন শ্রমিকদের পেছনে ভাঙচুর করতে, কারখানা বন্ধ করতে। সরকার ও শিল্পকে ধ্বংস করতে।”

শ্রমিকদের নামে দেওয়া দাবিগুলো ‘আসলে শ্রমিকদের নয়’ বলে মন্তব্য করেন প্যাট্রিয়ট গ্রুপের ইমরান।

বিজিএমইএ সভাপতি রফিকুল ইসলাম অভিযোগ করেন, শ্রমিকদের নামে ‘বিভিন্ন ফেডারেশন ও আন্তর্জাতিক চক্র’ ১৮ দফা দাবি তুলেছে।

সেই সভায় উপস্থিত সদস্যরা সিদ্ধান্ত নেন, নতুন করে মজুরি বৃদ্ধি এবং বছর শেষে ১০ শতাংশ হারে ইনক্রিমেন্ট দেওয়া নিয়ে কোনো ধরনের আলোচনা হবে না।

স্প্যারো গ্রুপের শোভন ইসলাম বলেন, “‘চাকরি চাই’ নামে একটা গ্রুপ তৈরি হয়েছে। ২০০-৩০০ জন, এমনকি হাজার মানুষ একসাথে জড়ো হচ্ছে। ভেতরে কয়েকজন ঢুকে চাকরি চাচ্ছে। বাকিরা বাইরে ঢিল ছুড়ছে।

“গত ৪০ বছরে তো এ শিল্পে এমন কিছু দেখি নাই। সবসময়ই কিছু লোক আসে। হয়ত অন্যখানে চাকরিতে অসুবিধা। যেখানে যায়, সুযোগ থাকলে মালিকরা তাদের নিয়েও নেন।”

কিন্তু ‘চাকরি চাই দল’ কারা, সেই প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, “কেউ নিশ্চয় তাদের পেছনে টাকা ঢালছে।”

মজুরি ও ‘ইনক্রিমেন্ট’ বাড়ানোর দাবি মানা হবে না বলে জানিয়েছে বিজিএমইএ। ফাইল ছবি

মজুরি ও ‘ইনক্রিমেন্ট’ বাড়ানোর দাবি মানা হবে না বলে জানিয়েছে বিজিএমইএ। ফাইল ছবি

কী বলছেন শ্রমিক নেতারা?

ওই দাবি শ্রমিকদের নয়– এ অভিযোগ ‘সত্য নয়’ বলে মন্তব্য করলেন গার্মেন্টস শ্রমিক নেত্রী নাজমা আক্তার।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “শ্রমিকদের বেতন কত? বর্তমান উচ্চমূল্যের বাজারে জীবন-জীবিকাইবা কীভাবে চলছে?”

তবে সাম্প্রতিক বিক্ষোভের পেছনে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ‘উসকানিও’ আছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “বিগত সরকারের সময়ে রাজনীতি রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছিল। করাপশন আছে। শ্রমিকরাও বিভিন্ন রাজনীতির সাথে জড়িয়ে গেছেন। মালিকরা ঘুষ দিয়ে শ্রমিকদের ম্যানেজ করেন। ফলে আন্দোলন ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হচ্ছে।”

শ্রমিকদের দাবির ‘যৌক্তিকতা’ তুলে ধরে গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক জলি তালুকদার বলেন, “বেশকিছু কারখানা বকেয়া দিচ্ছিল না। তাদের আন্দোলনের কিছু অংশ জেনুইন।”

এর বাইরে যা হচ্ছে, তার পেছনে ‘আগের সরকারের সঙ্গে মালিকের সংশ্লিষ্টতা’ একটি কারণ হতে পারে বলে মনে করেন জলি।

তিনি বলেন, “বিক্ষোভ বেশি হচ্ছে আগের সরকারের সাথে যাদের সম্পর্ক তাদের কারখানায়। মালিকরা দুর্নীতি, ঘুষ, ঝুট ব্যবসাকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভের মাত্রা বাড়াচ্ছে।”

শ্রমিকরা অনেকেই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়ে হতাহত হয়েছেন দাবি করে তাদের জন্য ব্যবস্থা নিতে সরকারের কাছে দাবি জানান জলি।

তিনি বলেন, “এই সরকারের প্রথম গুলি হয়েছে শ্রমিকের ওপর। এর তদন্ত করে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। এ খাত অস্থিতিশীল থাকলে দেশের ক্ষতি, রপ্তানির ক্ষতি। সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে আগের সরকারের সংশ্লিষ্টরা চেষ্টা করছে। এ খাত স্বাভাবিক করতে সরকারকে তাই কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।”

শ্রমিকদের ‘দাবি’

পোশাক খাতের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সম্প্রতি শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে শ্রমিক ও মালিক প্রতিনিধিদের একটি সভা হয়। সেখানে সভাপতিত্ব করেন মন্ত্রণালয়ের সচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান। বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের প্রতিনিধি এবং বিজিএমইএ সভাপতিসহ উদ্যোক্তারা সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

সভায় শ্রমিকদের পক্ষ থেকে ১৮টি দাবি কারখানা মালিকদের কাছে তুলে ধরা হয়।

দাবিগুলো হচ্ছে- মজুরি বোর্ড পুনর্গঠন করে শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি পুনর্নির্ধারণ; যেসব কারখানায় ২০২৩ সালে সরকার ঘোষিত ন্যূনতম মজুরি এখনো বাস্তবায়ন করা হয়নি, তা দ্রুত বাস্তবায়ন; শ্রম আইন সংশোধন; কোনো শ্রমিকের চাকরি ৫ বছর পূর্ণ হওয়ার পর চাকরি থেকে অব্যাহতি দিলে/চাকরিচ্যুত করলে একটি বেসিকের সমান অর্থ দেওয়া, শ্রম আইনের ২৭ ধারাসহ অন্যান্য ধারা সংশোধন।

এছাড়া সব বকেয়া মজুরি অবিলম্বে পরিশোধ; হাজিরা বোনাস (২২৫ টাকা), টিফিন বিল (৫০ টাকা), নাইট বিল (১০০ টাকা) সকল কারখানায় সমান হারে বাড়ানো; সকল কারখানায় প্রভিডেন্ড ফান্ড চালু; বেতনের বিপরীতে বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট ন্যূনতম ১০ শতাংশ করা; শ্রমিকদের জন্য রেশনের ব্যবস্থা করা; বিজিএমইএ নিয়ন্ত্রিত বায়োমেট্রিক ব্ল্যাকলিস্টিং বন্ধ করা; বায়োমেট্রিক তালিকা সরকারের নিয়ন্ত্রণে রাখা। (বায়োমেট্রিক লিস্টিং হল আঙ্গুলের ছাপ দিয়ে কারখানায় প্রবেশাধিকার। আঙ্গুলের ছাপ গ্রহণ না করলে কারখানায় প্রবেশ করতে পারেন না কর্মীরা।)

সকল প্রকার হয়রানিমূলক এবং রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহার; ঝুট ব্যবসার আধিপত্য বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ; কলকারখানায় নিয়োগ বৈষম্যহীন করা (নারী-পুরুষ সমান হারে নিয়োগ); জুলাই বিপ্লবে ‘শহীদ’ এবং আহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ ও চিকিৎসা সেবা; রানা প্লাজা এবং তাজরীন ফ্যাশন দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের কল্যাণে তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ; শ্রম আইন অনুযায়ী সকল কারখানায় ডে-কেয়ার সেন্টার স্থাপন; অন্যায্যভাবে শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধ করা এবং নারী শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন ছুটির মেয়াদ ১২০ দিন নির্ধারণের দাবি জানিয়েছেন শ্রমিকরা।

  

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
© All rights reserved © 2024 bornomalanews24.com
Design & Develop BY Coder Boss
themesba-lates1749691102