গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট ক্ষমতা ছেড়ে দিল্লি চলে যান শেখ হাসিনা। এর ফলে দীর্ঘদিন পর বাংলাদেশে স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটে। সরকার পতনে সত্যিকার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
শেখ হাসিনা সরকারের ১৫ বছরের অবসানের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয়। ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে শপথ নেন শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তার সঙ্গে যুক্ত হোন সুশীল সমাজের নেতারা।
ইউনূস একজন বিখ্যাত ব্যক্তি। বাংলাদেশে সত্যিকারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি একজন যোগ্য নেতা হবেন। তার জীবনের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে জনগণের মধ্যে সামাজিক সংহতি দৃঢ় হতে পারে। শেখ হাসিনার শাসনে অত্যাচারিত-নিপীড়িত মানুষেরা পেতে পারেন জীবনের নতুন স্বাদ। নাগরিক সুবিধা সংরক্ষণ এবং নানা সুবিধা বৃদ্ধি করতে পারেন। তবেই তিনি হবেন শান্তির দূত।
হাসিনার সরকারের আমলের গুম, খুন, হত্যা, নির্যাতন বন্ধ করতে পারেন। দুর্নীতিগ্রস্ত এনজিওগুলোকে সংস্কার করতে পারেন। আন্তর্জাতিক তহবিল পাওয়ার জন্য বিদেশি অনুদান আইন সংশোধন করতে পারেন। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার ভোগান্তি দূর করে নাগরিক জীবন সহজ করতে পারেন। তবেই তিনি স্মরণীয় হতে পারবেন।
এসব সংস্কার খুব দ্রুত করা উচিৎ। কারণ, ইতিহাস বলে- এমন সুযোগ ক্ষণস্থায়ী হয়। অভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরাচারী শাসন পতনের পর পরিস্থিতি দ্রুত পরিবর্তন হয়। এমন অবস্থায় গণতান্ত্রিক কাঠামো অভিজাতদের নিয়ন্ত্রণে চলে যেতে পারে। তাই, দ্রুত সিদ্ধান্ত না নিলে পরিস্থিতি পরিবর্তন ঘটবে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা না-ও হতে পারে পটপরিবর্তনের এমন পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী কুক্ষিগত করে। দেশের জাতীয়তাবাদী, কর্তৃত্ববাদী শক্তি এবং ধর্মপ্রচারক শাসক বনে যান।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সুদানের কথা। ২০১৯ সালে গণঅভ্যুত্থানে প্রভাবশালী প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশিরকে করা হয়। পরে দেশটিতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় অনেক চেষ্টা করা হয়। কিন্তু সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়। অবশেষে ২০২১ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করে।
১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে স্থিতিশীল গণতন্ত্রের জন্য একটি প্রাথমিক অভ্যুত্থান হয়। কারণ, দেশটিতে কয়েক দশক ধরে সামরিক শাসকরা সুশীল সমাজের ওপর ক্রমাগত আক্রমণ চালায়। ফলে দেশটির শাসকগোষ্ঠী গণতন্ত্রের জন্য প্রতিবাদ করা সাংবাদিক, বিভিন্ন দলের নেতাকর্মীসহ ভিন্নমতের মানুষদের ওপর দমন-পীড়ন চালায়। এখনো নীরবে চলছে এমন ঘটনা।
ইরিত্রিয়ার সঙ্গে ইথিওপিয়ার শান্তিচুক্তির জন্য ২০১৯ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পান দেশটির প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ। আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য অনকে প্রত্যাশা থাকলেও তা পূরণ হয়নি। পরে রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধে ব্যাপক নৃশংসতা সংঘটিত হয়েছিল ইথিওপিয়ায়।
গণঅভ্যুত্থানের পরও যদি ইউনূস সরকার সুশীল সমাজকে রাষ্ট্র সংস্কারে অংশগ্রহণ করাতে ব্যর্থ হন। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সচল করা সম্ভব না হয়, তাহলে হাসিনা পরবর্তী বাংলাদেশেও এমন পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। তবে এমনই হতে পারে, তা নয়। ঘটতে পারে ভিন্ন কিছু। সাধারণত গণঅভ্যুত্থানের পরে গণতন্ত্রপন্থি শক্তিগুলো দৃঢ় বা ভেঙে পড়তে পারে। কিন্তু এটি ব্যাপক এবং বাস্তবধর্মীও হতে পারে।
গণবিক্ষোভের মুখে দুই বছর আগে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। এটি একটি উদাহরণ হতে পারে। পুরোটা না হলেও গোতাবায়ার পদত্যাগের পর শ্রীলঙ্কায় গণতন্ত্রের উত্তরণ ঘটেছিল। গত মাসে অনুঢ়া কুমারা দেসনায়েকে আইনের শাসন ও স্থিতিশীলতার প্রতিশ্রুতি দেন। পরে তিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।
গুয়াতেমালায় পুরানো শাসনের দ্বারা শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর রোধ করার জন্য বারবার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও জানুয়ারিতে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি শপথ গ্রহণ করে। সেখানেও বাংলাদেশের নতুন সরকারের জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা থাকতে পারে।
সেনাবাহিনীর প্রতিরোধের পরও অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে ২০১৯-২২ সালে চিলিতে বড় বিক্ষোভ হয়। এতে দেশটির শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও পেনশনসহ একাধিক সংস্কার হয়। গুয়েতেমালায় শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য জানুয়ারিতে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি শপথ গ্রহণ করেন। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার সেখান থেকেও শিক্ষা নিতে পারে। এই দুটি দেশের পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সুশীল সমাজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
তবে বিপ্লব ও জনগণের অভ্যুত্থানের মুখে সরকার পতন হওয়া দেশগুলোর কোনোটাতেই জনগণের স্বপ্নরাষ্ট্র বা নিখুঁত গণতন্ত্র তৈরি হয়নি। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের এসব উদাহরণ থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিৎ। গণআন্দোলন বা গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতার পট পরিবর্তন হওয়া এসব দেশগুলোতে সুশীল সমাজ জনগণের আকাঙ্খা সংরক্ষণ করেছে এবং কঠিন ও জটিল সময়ে অবদান রেখেছে। তবে এমন ঘটনাগুলো থেকেও শিক্ষা নেওয়া উচিত; যেখানে গণতান্ত্রিক শক্তিগুলো প্রভাবশালী ব্যক্তিদের পতনে সাহায্য করেছিল, যা শেষ পর্যন্ত সমানভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত, গণতন্ত্রবিরোধী নেতাদের পূনর্বাসন করেছিল।
তবে এটা আশা করা ভুল, একটা নতুন সরকার সব ক্ষেত্রে সন্তোষজনক সংস্কার নিয়ে আসতে পারবে না। যুগ যুগ ধরে স্বৈরতন্ত্রকে মুছে দিয়ে কোনো বিপ্লবী সরকার রাতারাতি রাষ্ট্রের প্রতিটা ক্ষেত্রে গণতন্ত্র নিয়ে আসতে পারবে না। কিন্তু বিশ্বজুড়ে এমন অনেক উদাহরণ আছে- যেখানে দীর্ঘমেয়াদী স্বৈরাচারের রেখে যাওয়া ধ্বংসাবশেষের ওপর উন্নত রাষ্ট্র গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে। তবে নতুন সরকার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে সুশীল সমাজের সঙ্গে সংলাপে গেলে এবং গণতান্ত্রিক পথে থাকলেই স্বপ্নরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব।
নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. ইউনূস যদি ভুল করেন। অন্তর্বর্তী সরকার নাগরিক সমাজ, বিক্ষোভ ছাড়াও গণতান্ত্রিক ভিন্নমতকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা শুরু করে, তবে বুমেরাং হয়ে যেতে পারে গণতান্ত্রিক স্বপ্ন। তাহলে ফিরে আসবে অতীতের স্বৈরাচারী ধারা।
অতীতে রাষ্ট্র সংস্কারের সময় যে ভুলগুলো হয়েছিল, সেগুলো বাংলাদেশেও পুনরাবৃত্তি হতে পারে। ভেস্তে যেতে পারে গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্খা। এমন পরিস্থিতি তৈরি হলে কর্তৃত্ববাদী শাসনের দীর্ঘ ইতিহাসে পাদটীকায় পরিণত হবে বাংলাদেশ।
কিন্তু অধ্যাপক ড. ইউনূস যদি এসব অন্যান্য দেশের সফল অভিজ্ঞতা থেকে পরিকল্পনা করেন, বাংলাদেশকে একটি শক্তিশালী গণতন্ত্রের ভিত্তির ওপর স্থাপন করতে পারেন। তবে তিনি ম্যান্ডেলার মতো অনুপ্রেরণাদায়ী ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠতে পারেন। তা না হলে বাংলাদেশ তলিয়ে যাবে সংকটের অতল গভীরে।
বাংলাদেশ একটি মোড়ের মধ্যে রয়েছে। বর্তমান সংকট এবং সমস্যা থেকে ইউনূস ও তার উপদেষ্টারা কীভাবে মানবাধিকার ও নাগরিক স্বাধীনতাকে সম্মান করে বর্তমান রাজনৈতিক গতিশীলতাকে নেভিগেট করতে সক্ষম হচ্ছেন, তা বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে।