ওয়াকফ বোর্ডগুলোতে যে দুর্নীতি একটি বড় সমস্যা, সে বিষয়ে মুসলিম গোষ্ঠীগুলো একমত। বোর্ডের সদস্যদের বিরুদ্ধে দখলদারদের সঙ্গে যোগসাজশে ওয়াকফ জমি বিক্রি করে দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে।
ভারতে মুসলিমদের দান করা সম্পত্তি, অর্থাৎ ওয়াকফ সম্পত্তির ব্যবস্থাপনা গঠিত কয়েক; দশকের পুরনো একটি আইন সংশোধন করার উদ্যোগে দেশটির মুসলিমদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।
বিবিসি জানিয়েছে, আইনটি সংশোধনে ভারতের পার্লামেন্টে যে নতুন বিল আনা হচ্ছে তাতে ৪০টির বেশি সংশোধনীর কথা বলা হয়েছে।
পার্লামেন্টের সদস্যদের নিয়ে গঠিত একটি যৌথ কমিটির প্রয়োজনীয় সুপারিশসহ চলতি অধিবেশনেই বিলটি তোলার আশা করা হয়েছিল। কিন্তু ওই কমিটি এখন তাদের সুপারিশ জমা দিতে আরও সময় চেয়েছে।
ভারতে মসজিদ, মাদ্রাসা, আশ্রয়কেন্দ্র এবং হাজার হাজার একর ওয়াকফ জমির ব্যবস্থাপনা একটি বোর্ডের মাধ্যমে পরিচালিত হয়।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সরকার বলছে, ওয়াকফ সম্পত্তি ব্যবস্থাপনায় দুর্নীতির মূলোৎপাটন এবং আইনটির সংস্কারে মুসলিমদের দাবির প্রেক্ষিতেই আইন সংশোধন করা হচ্ছে।
তবে কয়েকটি মুসলিম গোষ্ঠী এবং বিরোধী দল এসব সংশোধনীকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং সংখ্যালঘুদের অধিকার খর্ব করতে মোদীর হিন্দু জাতীয়তাবাদী দলের প্রচেষ্টা বলে অভিহিত করেছে।
বিলটি প্রথম অগাস্টে পার্লামেন্টে তোলা হলেও পরে প্রয়োজনীয় সুপারিশের জন্য যৌথ সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হয়।
ওয়াকফ কি?
ইসলামী ঐতিহ্য অনুযায়ী, মুসলিমরা নিজেদের সম্প্রদায়ের মানুষের কল্যাণে তাদের সম্পত্তি দান করে। এটিই হচ্ছে ওয়াকফ বা ধর্মীয় দান। এসব সম্পত্তি আল্লাহর, তাই এগুলো বিক্রি বা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যাবে না, এমন ধারণা প্রচলিত।
ওয়াকফ সম্পত্তির একটি বিশাল অংশ মূলত মসজিদ, মাদ্রাসা, কবরস্থান এবং এতিমখানা নির্মাণে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া অনেক সম্পত্তি খালি পড়ে থাকে নয়ত বেদখল হয়ে যায়।
দ্বাদশ শতাব্দীতে মধ্য এশিয়ার শাসকরা দিল্লির সালতানাতে বসার পর থেকেই ভারতে ওয়াকফ ঐতিহ্য চলে আসছে।
এসব ওয়াকফ সম্পত্তি এখন ওয়াকফ অ্যাক্ট, ১৯৯৫ এর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়। এই আইনের অধীনে রাজ্যভিত্তিক বোর্ড গঠন করা হয়। এসব বোর্ডে রাজ্য সরকারের মনোনীত ব্যক্তি, মুসলিম আইন প্রণেতা, রাজ্য বার কাউন্সিলের সদস্য, ইসলামিক পণ্ডিত এবং ওয়াকফ সম্পত্তির ব্যবস্থাপক অন্তর্ভুক্ত থাকেন।
দেশটির সরকার বলছে, ভারতে এখন যারা বিশাল বিশাল জমির মালিক, তাদের মধ্যে ওয়াকফ বোর্ডগুলো অন্যতম।
সরকারের তথ্য অনুযায়ী, ভারতজুড়ে কমপক্ষে ৮৭২৩৫১টি ওয়াকফ সম্পত্তি রয়েছে।
নয় লাখ ৪০ হাজারের বেশি একরের এসব সম্পত্তির আনুমানিক মূল্য ১ লাখ ২০ হাজার কোটি রুপি।
সংস্কারের কি আদৌ প্রয়োজন?
ওয়াকফ বোর্ডগুলোতে যে দুর্নীতি একটি বড় সমস্যা, সে বিষয়ে ভারতের মুসলিম গোষ্ঠীগুলো একমত। বোর্ডের সদস্যদের বিরুদ্ধে দখলদারদের সঙ্গে যোগসাজশে ওয়াকফ জমি বিক্রি করে দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে।
কিন্তু সমালোচকরা বলছেন, এসব সম্পত্তির একটি বড় অংশ বিভিন্ন ব্যক্তি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি বিভিন্ন সংস্থা দখল করে নিয়েছে। এসব অভিযোগের দিকেও মনোযোগ দেওয়া দরকার বলে মনে করেন তারা।
২০০৬ সালে কংগ্রেস সরকারের মেয়াদে গঠিত বিচারপতি সাচার কমিটি ভারতের মুসলিমদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা মূল্যায়ন করে একটি প্রতিবেদন দিয়েছিল।
ওই কমিটির পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছিল, ওয়াকফ বোর্ডগুলো যে পরিমাণ সম্পত্তির মালিক, তার তুলনায় তাদের রাজস্ব আয়ের পরিমাণ অনেক কম। এ কারণে সাচার কমিটি ওয়াকফ আইন সংস্কারের সুপারিশ করেছিল।
কমিটির তখনকার হিসাব অনুযায়ী, ওয়াকফ ভূমির যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে ১২ হাজার কোটি রুপি রাজস্ব আয় করা সম্ভব ছিল।
বর্তমানে ওয়ারকফ বোর্ডগুলোর বার্ষিক রাজস্ব আয় ২০০ কোটির আশপাশে বলে কিছু পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে।
কমিটির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছিল, ওয়াকফর মূল রক্ষক যারা, সেই রাজ্য সরকারগুলোর দ্বারাই এসব সম্পত্তি দখল হওয়াটা খুব সাধারণ বিষয়।
সরকারি কর্তৃপক্ষের দখল করে নেওয়া ওয়াকফ সম্পত্তির শত শত প্রমাণ পেয়েছিল সাচার কমিটি।
সরকারি তথ্য অনুসারে, বর্তমানে কমপক্ষে ৫৮৮৮৯টি ওয়াকফ সম্পত্তি অবৈধভাবে দখলে আছে। এসব দখলের ঘটনায় মামলা রয়েছে ১৩ হাজারের বেশি।
এর বাইরে ৪৩৫০০০টি সম্পত্তির কোনো হদিস নেই।
কেন্দ্রীয় সরকার বলছে, আইনের সংশোধনীগুলো এসব সমস্যা সমাধানের পাশি সাচার কমিটির সুপারিশগুলো বাস্তবায়নকে এগিয়ে নেবে।
ভারতের সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী কিরেন রিজিজু টাইমস অব ইন্ডিয়াকে বলেছেন, মুসলিম সম্প্রদায়ের শুধূ একটি অভিজাত অংশ এসব সম্পত্তির ব্যবস্থাপনায় রয়েছে, তাই এর (ওয়াকফ আইন) সংস্কার প্রয়োজন ছিল।
কেন বিতর্ক?
মুসলিম অনেকেই আইনের প্রস্তাবিত সংশোধনীগুলোকে সন্দেহের চোখে দেখছেন।
বিলের সবচেয়ে বিতর্কিত প্রস্থাবগুলোর একটি হল ওয়াকফ সম্পত্তির মালিকানা বিধিতে পরিবর্তন, যা বোর্ডের অধীনে থাকা অনেক ঐতিহাসিক মসজিদ, দরগা এবং কবরস্থানগুলোর ওপর প্রভাব ফেলবে।
এসব সম্পত্তির অনেকগুলোই কয়েক প্রজন্ম ধরে মুসলমানরা ব্যবহার করছে। কিন্তু এসব সম্পত্তির নথিপত্র নেই। কারণ কয়েক দশক বা শতাব্দী আগে মৌখিকভাবে বা আইনি নথি ছাড়াই এগুলো দান করা হয়েছিল।
১৯৫৪ সালের ওয়াকফ আইনের মাধ্যমে এসব সম্পত্তি ‘ব্যবহারকারীর ওয়াকফ’ হিসেবে গণ্য হতো। কিন্তু প্রস্তাবিত সংশোধনীতে সেই বিধানটি বাদ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। ফলে ওয়াকফ সম্পত্তির বিশাল একটি অংশর ব্যবস্থাপনা অনিশ্চিত হয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
শিকওয়া-ই-হিন্দ: দ্য পলিটিক্যাল ফিউচার অফ ইন্ডিয়ান মুসলিমস-এর লেখক অধ্যাপক মুজিবুর রেহমানের ভাষ্য, এই ধরনের দীর্ঘস্থায়ী সম্প্রদায়ের সম্পত্তির মালিকানা খুঁজে বের করা জটিল, কারণ তাদের ব্যবস্থাপনা এবং কাজের পদ্ধতি কয়েকশ বছর আগের মুঘল ব্যবস্থা থেকে শুরু ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সময় এবং বর্তমান পর্যন্ত চলে এসেছে।
“আপনি কয়েক প্রজন্ম পর্যন্ত ব্যক্তিগত সম্পত্তির সন্ধান করতে পারেন, তবে একটি সম্প্রদায়ের সম্পত্তি শনাক্ত করা আরও কঠিন, কারণ তাদের ব্যবস্থাপনা সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়।”
অনেকেই বলছেন, নতুন বিলটি মুসলিমদের উদ্বেগের সমাধান করতে না পারলেও ওয়াকফ সম্পত্তি নিয়ন্ত্রণে তাদের ভূমিকা উল্লেখযোগ্যভাবে কেড়ে নিতে পারে।
কারণ ওয়াকফ বোর্ডের গঠনতন্ত্র পরিবর্তন, অমুসলিমদের সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত বাধ্যতামূলক করার কথা বলা হয়েছে সংশোধনীতে।
কেউ কেউ এই বিধানের পক্ষেও মত দিয়েছেন। তাদের ভাষ্য, একটি সাধারণ আইনের মাধ্যমে ধর্মীয় সম্পত্তিগুলো পরিচালনা করতে সব ধর্মের মানুষদের বোর্ডের অংশ হওয়াটা খারাপ হবে না, কারণ এর ফলে পুরো প্রক্রিয়া ধর্মনিরপেক্ষ হয়ে উঠবে।
তবে আইন সংশোধনের বর্তমান পদক্ষেপটি সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনীতির পক্ষে যাবে বলে মনে করেন অধ্যাপক রেহমান।
“শুধু মুসলমানদের সম্পত্তির উপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ নয়, মুসলিমদের ওপর হিন্দু সম্প্রদায়ের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে,” বলেন তিনি।
গুরুত্বপূর্ণ আরেক পরিবর্তনের প্রস্তাব
সংশোধনী প্রস্তাবে ওয়াকফ বোর্ডগুলোকে জেলা কালেক্টরদের কাছে তাদের সম্পত্তির নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করার কথা বলা হয়েছে।
পরে জেলা কালেক্টররা সরকারকে সুপারিশ করবেন, কোনো সম্পত্তিতে ওয়াকফের দাবি বৈধ কি না।
সমালোচকরা বলছেন, এটি ওয়াকফ বোর্ডের ক্ষমতা খর্ব করবে।
ভারতীয় পার্লামেন্টের সদস্য আসাদউদ্দিন ওয়াইসির অভিযোগ, এই বিধান মুসলমানদের জমি কেড়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে করা হয়েছে।
বর্তমান আইনে রাজ্য সরকারগুলো একজন জরিপ কমিশনার নিয়োগ করে, যিনি ওয়াকফ সম্পত্তি চিহ্নিত করে একটি তালিকা প্রস্তুত করেন। তারপর তালিকাটি রাজ্য সরকারের কাছে পাঠানো হয়। পরে যা আইনি বিজ্ঞপ্তি করা হয়। এক বছরের মধ্যে কোনো দাবিদার পাওয়া না গেলে ওই সম্পত্তির চূড়ান্তভাবে ওয়াকফ হয়ে যায়।
সংশোধনের ফলে কিছু ওয়াকফ সম্পত্তির বর্তমান অবস্থা বদলে যাবে বলে মনে করেন আসাদউদ্দিন ওয়াইসি।
“অনেকে অবৈধভাবে ওয়াকফ সম্পত্তি দখল করে আছে। এর মানে (নতুন আইনে) তারা দাবি করার সুযোগ পাবে যে সম্পত্তিটি তাদের,” বলেন তিনি।
মুসলিম দলগুলো বলছে, আইন সংশোধনের এই প্রক্রিয়া অনেক ঐতিহাসিক দরগা ও মসজিদকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে।
তাদের ভাষ্য, সংস্কার প্রয়োজন তবে সেক্ষেত্রে অবশ্যই সম্প্রদায়ের সংবেদনশীলতা এবং স্বার্থ মাথায় রাখতে হবে।
“রোগ নির্ণয় সঠিক হতে পারে, কিন্তু চিকিৎসা নয়,” বলেন অধ্যাপক অধ্যাপক মুজিবুর রেহমান।