“আমার জীবনে এরকম দাম কখনও দেখি নাই। ১৮ বছর ধরে কারওয়ান বাজারে ব্যবসা করতেছি। ৯০ টাকায় পাইকারিতে কখনও ঢ্যাঁড়স কিনিও নাই, আবার এটা ১০০ টাকা কেজি দরে কখনও বিক্রিও করি নাই। সবকিছুর এতো দাম বাড়ছে।”
রাজধানীতে তুলনামূলক কম দামে যে বাজারে নিত্যপণ্য পাওয়া যায়, সেই কারওয়ান বাজারের সবজি বিক্রেতা আমির চান এ কথা বলছিলেন বিস্ময় চোখে।
অভিজ্ঞতা থেকেই বললেন, সাম্প্রতিক বৃষ্টিতে সবজির গাছ মরে যাওয়ায় উৎপাদনে যে ঘাটতি দেখা দিয়েছে তা এ মাসে পূরণ হবার নয়।
“নভেম্বরে শীতকালীন সবজি বাজারে আসলে দাম কমবে। এর আগে দাম কমবে না। বাজার আপাতত গরমই থাকবে।”
মহাখালীর আমতলী এলাকার বাসিন্দা নিফাত সুলতানা বাসা থেকে বেরোতেই দেখতে পান সবজির ভ্যান। দোরগোড়ায় সবজিওয়ালাকে পেয়েই জিজ্ঞেস করলেন, চিচিঙ্গার কেজি কত?
বিক্রেতা জানালেন- ১২০ টাকা, এই দামের নিচে তিনি বেচবেন না। শেষ পর্যন্ত আর সবজিই কেনা হয়নি নিফাতের।
আক্ষেপ নিয়ে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বললেন, “ভেবেছিলাম সবজি কিনব। কিন্তু চিচিঙ্গার দাম শুনেই রাগ হচ্ছিল। পরে আর অন্য কোনো সবজিরও দাম জানতে ইচ্ছে করেনি। কারণ সেগুলোর দাম হয়তো আরও বেশি হবে।
“নরমালি চিচিঙ্গার দাম কিছুটা কমই থাকে। পরে সবজি না কিনে বাসায় এসে ফ্রিজে থাকা আগের সবজিই রান্না করে খেতে হয়েছে।”
ডিমের দামে উল্লম্ফন নিয়ে হইচইয়ের মধ্যেই বাজারে অভিযান পরিচালনার কথা ফেইসবুকে চাউর হয়েছে। এই অভিযানের পর নিত্যপণ্যটির দাম কমেছে বলে ধরেই নিয়েছিলেন মোল্লা মুহম্মদ আহাদ। তবে বাজারে গিয়ে নিজেকে ‘বোকা’ হিসেবে আবিষ্কার করলেন তেজগাঁওয়ের এই বাসিন্দা।
“ফেইসবুকে বিভিন্ন অভিযানের কথা শুনে ভেবেছিলাম ডিমের দাম কমেছে। তাই আগ্রহবশত দাম জিজ্ঞেস করলাম। কিন্তু একাধিক দোকানের বিক্রেতা একই কথা বলল, ৬০ টাকা হালি ডিম। মানে ডজন ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা। তাহলে দাম আর কোথায় কমল?”
‘সবজির দাম এখন ফলের মতো’
বিজয় সরণির কলমিলতা কাঁচা বাজারের সবজি বিক্রেতা সবুজ জানালেন, আগের সপ্তাহের চেয়ে এই সপ্তাহে সব ধরনের সবজিতে কেজিতে অন্তত ৩০ টাকা দাম বেড়েছে।
তিনি বলেন, “গতকাল ঢ্যাঁড়স বিক্রি করছি ৮০ টাকায়। আর আজ ৯০ টাকায়ই আমার কেনা। বিক্রি করতে হবে ১০০ টাকার উপরে।
“এখন বলতে গেলে ১০০ টাকার নিচে কোনো সবজি নাই। আবার পেঁয়াজের দামও বাড়ছে। আজ সকালে কারওয়ান বাজার থেকে পেঁয়াজ কিনলাম ১১৮ থেকে ১২০ টাকা কেজি হিসেবে।”
সবুজের দোকানে চিচিঙ্গা ও পটল ছাড়া ১০০ টাকার নিচে কোনো সবজি পাওয়া যায়নি। কেবল এই দুই সবজি মিলছে ৮০ টাকা কেজি দরে।
সবুজ জানালেন, এই দুই পণ্য একদিন আগে তার কেনা। এ কারণে তিনি কিছুটা কমে বেচতে পাচ্ছেন।
সবুজ টমেটো বিক্রি করছেন ২৪০ টাকা কেজি দরে, গোল বেগুন ১২০ টাকা, লম্বা বেগুন ১০০ টাকা, করলা ১০০ টাকা, চীনা গাজর ১৬০ টাকা, কাকরোল ১০০ টাকা এবং বরবটি ১২০ টাকা কেজি দরে বেচছিলেন।
তার কাছে পেঁয়াজের কেজি ১২৫ টাকা, আর আলুর দাম ৬০ টাকা।
সবুজের দোকানে ৪০ টাকায় দুটো টমেটো কিনলেন নাখালপাড়ার বাসিন্দা আশরাফুল ইসলাম সবুজ।
তিনি বলছিলেন, “মাছের সঙ্গে টমেটো দিয়ে রান্না করব; আর আমি একাই থাকি, তাই মাত্র দুইটা টমেটো নিলাম। কিন্তু দুইটা টমেটোর দাম যে ৪০ টাকা হয়ে যাবে, এটা খুবই অপ্রত্যাশিত।
“দুইটা আপেলের দামই তো ৪০ টাকা বা তার একটু উপরে। মানে ফলের সমান যদি সবজির দাম হয় তাহলে বিষয়টা কেমন হয়ে গেল না?
কারওয়ান বাজারও ‘অচেনা’
অন্যবাজারের তুলনায় কারওয়ান বাজারে কিছুটা কম দামে সবজি পাওয়া গেলেও সেই বাজারটিকে শুক্রবার অচেনা ঠেকছে অনেকের কাছে।
এ বাজারে ক্রেতাদের গোল বেগুন কিনতে হচ্ছে ১২০ থেকে ১৪০ টাকা কেজি দরে; লম্বা বেগুন, ওস্তা, ঢ্যাঁড়স ও ধুন্দল ১০০ টাকায়, চিচিঙ্গা ৮০ টাকায়, টমেটো ২৫০ টাকায়, বরবটি ১৪০ টাকায়, গাজর ১৮০ টাকায় এবং প্রতিটি লাউ বিক্রি হচ্ছে ৭০ টাকা দরে।
অসহায়ত্ব প্রকাশ করে আজিজুল ইসলাম নামের এক ক্রেতা বললেন, “এমন চড়া দাম এই বাজারে শেষ কবে দেখেছি- জানি না। চিরচেনা কারওয়ান বাজারেও সবজি আজ চড়া।
“আমি ধানমন্ডি থেকে প্রতি শুক্রবার এখানে সাপ্তাহিক বাজার করতে আসি। এখানে একটু কমে পাই অন্য বাজারের তুলনায়। কিন্তু আজকের বাজারের চিত্র আমার কাছে একেবারেই অচেনা।”
মরিচ আবার ৪০০ টাকায়
বাজারে আবারও মরিচের দর উঠেছে ৪০০ টাকায়। অথচ সপ্তাহ দুয়েক আগেও ২২০ থেকে ২৫০ টাকার মধ্যে মরিচ মিলছিল।
কারওয়ান বাজারের বিক্রেতা জয়নাল বলেন, “এই দেশে এখন ১০০ টাকার নিচে কিছুই নাই। মরিচের দাম এখন বেশি। আমাদের কেনাই পড়ছে ৩৮০ টাকার উপরে।
“আরেকটা মরিচ আছে, যেটার ঝাল কম। সেটার দাম ৩৫০ টাকায় পাওয়া যায়, কিন্তু সেটার চাহিদা কম।”
পেঁয়াজের বাজার ঊর্ধ্বগামী
কলমিলতা বাজারে পাবনার পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১২৫ টাকা কেজি দরে। এই বাজারের বিক্রেতারা দাবি করলেন, কারওয়ান বাজারে পাইকারিতে এই পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১১৮ থেকে ১২০ টাকায়।
পরে কারওয়ান বাজারে গিয়ে দেখা গেল, কারওয়ান বাজারে পাবনার পেঁয়াজ কোথাও পাইকারিতে বিক্রি হচ্ছে ১১৬ টাকা কেজি, আবার কোথাও ১১৮ টাকা কেজি দরে।
স্বদেশ বাণিজ্যালয়ের বিক্রেতা আলামিন হোসেন বললেন, পেঁয়াজের বাজার এখন ঊর্ধ্বগামী।
“দামের এখন কোনো ঠিক-ঠিকানা নাই। ৫-৭ দিন আগের চেয়ে এখন কেজিতে ৫ টাকার মতো বাড়ছে “
আলু-পেঁয়াজের খুচরা বিক্রেতা বাদশা মিয়া বলেন, “এক সপ্তাহের তুলনায় ৫ টাকা বাড়ছে পেঁয়াজে। এখন ১২০ টাকা করে বিক্রি করতেছি পাবনারটা।”
নবাবপুরে ইলেক্ট্রিক মার্কেটে দোকান রয়েছে মোশাররফ হোসেনের। তিনি পেঁয়াজ কিনেছেন ৩ কেজি।
মোশাররফ বললেন, “বিজনেসের অবস্থা ভাল না। আমার ইলেক্ট্রিক পণ্যের দাম কিন্তু বাড়ে নাই।
“কিন্তু পেঁয়াজসহ সব নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে। বাজারে যে সিন্ডিকেট থাকে, সেগুলো ভাঙাই হবে এই সরকারের প্রধান চ্যালেঞ্জ।”
বাজারে পাইকারিতে ফরিদপুরের পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১০৪ থেকে ১০৬ টাকা কেজি দরে।
এই বাজারের মাতৃভান্ডারে ফরিদপুরের পেঁয়াজ বেচতে দেখা গেল। বিক্রেতা আব্দুস সালাম বলেন, “পেয়াজের কেজি লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তেছে আগের মতো। কয়েকদিন আগেও বেচছি ৯০ টাকা, ৯২ টাকা। এখন ১০৪ টাকা।”
তবে দাম বাড়েনি ভারতীয় পেঁয়াজের। আগের মতোই প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৯০ থেকে ৯৫ টাকার ভেতরেই।
এছাড়াও বাজারে আলু বিক্রি হচ্ছে ৫৫ টাকা কেজি দরে, চীনা আদা ২০০ টাকা ও চীনা রসুন ২২০ টাকায় কিনছেন ক্রেতারা।
মুরগির দর বাড়লেও ‘কিছুটা’ কমেছে ডিমের দর
চার দিন ধরে বাজারে ব্রয়লার বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকা কেজি দরে, যা আগে ১৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছিল।
শুক্রবার সোনালি মুরগি বিক্রি হচ্ছিল ৩০০ টাকা কেজি দরে; অথচ দুদিন আগেও তা বিক্রি হয়েছে ২৭০ টাকা কেজি দরে।
কারওয়ান বাজারের বাংলা চিকেন হাউজের বিক্রেতা এম ফয়েজ হাসান বলেন, “সবজি-ডিমের বাজারে যাইয়া দেখেন কি দাম? এসবের সাথে পাল্লা দিয়া মুরগির দাম বাড়াইছে খামারিরা। হঠাৎ কইরা শুনি দাম বাড়তি।”
দাম বাড়ার কারণে বিক্রি কমেছে জানিয়ে তিনি বলেন, “দাম বাড়লে একটা খারাপ প্রভাব পড়ে ৩-৪ দিন। পাবলিক মনে করে, বেশি রাখতেছি। পরে আবার অ্যাডজাস্ট হয়ে যায়।”
তবে ডিমের দাম কিছুটা কমেছে কারওয়ান বাজারে, ডজনে ১০ টাকার মতো। বাজারে সাদা ও লাল ডিম বিক্রি হচ্ছে ৫৩ থেকে ৫৫ টাকা হালিতে, ডজন হিসাবে বিক্রি হচ্ছে ১৫৫ থেকে ১৬০ টাকায়; আর হাঁসের ডিম ৭৫ টাকা হালি দরে বিক্রি হচ্ছে, তাতে প্রতি ডজনের দাম পড়ছে ২২০ টাকা।
কারওয়ান বাজারে গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৭৫০ কেজি দরে, তবে কলমিলতা বাজারে তা মিলছে ৩০ টাকা কমে। আর দুই বাজারেই খাসির মাংস বিক্রি হচ্ছে ১১০০ টাকা কেজি দরে।
পূজায় গরম ইলিশের বাজার
দুর্গাপূজা উপলক্ষে রাজধানীর বাজারগুলোতে ইলিশের দাম বেড়েছে কেজিতে অন্তত ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা।
এক কেজি ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ২১০০ থেকে ২২০০ টাকা কেজি দরে, ৯০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ২০০০ টাকা, ৮০০ গ্রাম ওজনের ইলিশের দাম ১৭০০ থেকে ১৮০০ টাকা কেজি।
৭০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ১৬০০ থেকে ১৭০০ টাকা কেজি দরে এবং ৬০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ১৫০০ টাকা কেজি দরে।
ইলিশ বিক্রেতা আব্দুস সালাম বলেন, “গত দেড় সপ্তাহে ইলিশ মাছের দাম কেজিতে বেড়েছে ২৫০-৩০০ টাকা। আর এই এক সপ্তাহ ধরে এই দাম বেশি বাড়ছে।”
বাজারে পাবদা মাছ বিক্রি হচ্ছে ৪৫০ টাকা, কাতল ও রুই ৩২০ থেকে ৪২০, কৈ ২২০, তেলাপিয়া ও পাঙ্গাস মাছ বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকা কেজি দরে।
মাছ বিক্রেতা আব্দুর রহমান বলেন, “সবকিছুর দাম বাড়ছে, মাছের দাম কম থাকবে কেন? মাছেরও দাম ১০ থেকে ১৫ টাকার মতো বাড়ছে; মাছ চাষি বা ব্যবসায়ীদেরও তো পরিবার আছে।”