সম্প্রতি দেশে ডলার প্রবাহে বেশ উন্নতি হয়েছে। এতে করে আমদানি দায় ও বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপও কমে এসেছে। তবে, ডলার সরবরাহ বাড়লেও বৈদেশিক বাণিজ্য নিয়ে দেশের ব্যাংকগুলো স্বস্তিতে নেই। বিদেশি ব্যাংকগুলো ঋণসীমা কমিয়ে দেওয়ায় ঋণপত্র (এলসি) খুলতে বিড়ম্বনা রয়ে গেছে।
‘কান্ট্রি রেটিং’ খারাপ হওয়া ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে উন্নীত না হওয়ায় ঋণপত্র (এলসি) খুলতে দেশের ব্যাংকগুলোকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ব্যাংকগুলোর গ্যারান্টির প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশের এলসির গ্যারান্টির বড় অংশই দেয় মধ্যপ্রাচ্যের ব্যাংকগুলো। ভারত ও ইউরোপ-আমেরিকার বড় ব্যাংকগুলোও কিছু এলসির গ্যারান্টর হয়। এ জন্য একটি ঋণসীমা অনুমোদিত থাকে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর জন্য।
একটি বেসরকারি ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, বিদেশি ব্যাংকগুলো ঋণসীমা কমিয়ে দেওয়ায় এলসি খুলতে বিড়ম্বনা পোহাতে হচ্ছে। এক-দেড় বছর আগের তুলনায় বর্তমানে দেশের ব্যাংক খাতে ডলারের সরবরাহ ভালো। কিন্তু দেশের কিছু ব্যাংকের নাজুক পরিস্থিতির কারণে বিদেশিদের কাছে খারাপ বার্তা যাচ্ছে। এমনিতেই বাংলাদেশের কান্ট্রি রেটিং খারাপ, তার সঙ্গে ব্যাংক খাতের অস্থিরতা তৈরি হওয়ায় ঋণসীমা কমিয়ে দিয়েছে বিদেশি ব্যাংকগুলো। অর্থনৈতিক স্থবিরতার কারণে এমনিতেই আমদানির চাহিদা কম। যে চাহিদা আসছে, বিদেশি ব্যাংকগুলো ঋণসীমা কমিয়ে দেওয়ার কারণে সে এলসিও খোলা যাচ্ছে না।
ডলার সংকটের কারণে দুই বছর ধরেই বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর জন্য ঋণসীমা কমিয়ে এনেছে বিদেশি ব্যাংকগুলো। সম্প্রতি পরিস্থিতি আরো বেশি নাজুক হয়েছে। ১১টি বেসরকারি ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দেওয়া, তারল্য সংকট ও নানা নেতিবাচক প্রচারণার কারণে বিদেশি অনেক ব্যাংকই বাংলাদেশের কিছু ব্যাংকের এলসি নিচ্ছে না। যে ব্যাংকগুলোর আর্থিক সক্ষমতা বেশ ভালো, তাদের জন্যও ঋণসীমা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। এলসি খোলার জন্য দেশের ব্যাংকগুলোকে বাড়তি কমিশন বা ফিও গুনতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
‘থার্ড পার্টি গ্যারান্টি’ হিসেবে আমদানির ক্ষেত্রে সংযুক্ত আরব আমিরাতভিত্তিক মাশরেক ব্যাংকের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি ব্যবসা রয়েছে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর। মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী ব্যাংকটি বাংলাদেশের বেশিরভাগ ব্যাংকেরই এলসির গ্যারান্টর হয়।
রাজনীতির পাশাপাশি ব্যাংক খাতের অস্থিরতার কারণে ব্যাংকটি দেশের অনেক ব্যাংকেরই ঋণসীমা বন্ধ করে দিয়েছে। ভারত, সিঙ্গাপুর, সৌদি আরব, আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের আরও কিছু ব্যাংক ঋণসীমা কমিয়ে দিয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যাংক নির্বাহীরা। ইউরোপের ব্যাংকগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি ব্যবসা রয়েছে জার্মানির কমার্স ব্যাংকের। সেটিও দেশের কিছু ব্যাংকের এলসি নিচ্ছে না।
দেশের ডলার প্রবাহ ও বৈদেশিক বাণিজ্য পরিস্থিতির প্রকৃত চিত্র পাওয়া যায় ‘ব্যালান্স অব পেমেন্ট’ শীর্ষক প্রতিবেদনে, যা বিওপি হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশ ব্যাংকের তৈরি করা বিওপির সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি ২০২৪-২৫ অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে এক হাজার তিন কোটি ডলার দেশের আমদানি ব্যয় ছিল। নতুন অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে এ ব্যয় ৯৯১ কোটি ডলারে নেমে এসেছে। এক্ষেত্রে আমদানি ব্যয় কমেছে ১.২ শতাংশ।
আমদানি কমলেও আগের তুলনায় চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২.২৫ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে রপ্তানি আয় ছিল ৬৯৮ কোটি ডলার, চলতি অর্থবছরে তা বেড়ে উন্নীত হয়েছে ৭১৬ কোটি ডলারে। আর চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় বেড়েছে ১৫.৮ শতাংশ। ব্যয়ের তুলনায় ডলার প্রবাহ বাড়ায় সরকারের চলতি হিসাব উদ্বৃত্তের ধারায় ফিরেছে।
গত অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে চলতি হিসাবে ৬১ কোটি ডলার ঘাটতি থাকলেও চলতি অর্থবছরের একই সময়ে উদ্বৃত্ত রয়েছে ১১ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরে দেশের আর্থিক হিসাবের (ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট) ঘাটতিও কমেছে। সব মিলিয়ে আগস্ট শেষে বিওপির ঘাটতি ছিল ১৩৯ কোটি ডলার। গত অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে বিওপিতে ঘাটতি ছিল ১৬৯ কোটি ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে আমদানির এলসি খোলা ১২.৯৬ শতাংশ কমে গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৪৩.১ শতাংশ কমেছে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি। আর আগস্ট পর্যন্ত প্রথম দুই মাসে আমদানির এলসি নিষ্পত্তি কমেছে ১৩ শতাংশেরও বেশি।