জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কমবেশি পুরো বিশ্বই ক্ষতির মুখে পড়ছে। অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, তাপমাত্রা অস্বাভাবিক কমে বা বেড়ে যাওয়ার ঘটনা বাড়ছেই। বাধ্য হয়ে পরিবেশবান্ধব পণ্য ব্যবহারে নজর দিচ্ছে বিভিন্ন দেশ। পরিবেশ দূষণে বড় দায় রয়েছে পলিথিনের। এ কারণে ২০০২ সালে পলিথিন নিষিদ্ধ হয় দেশে। তবে সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী বিকল্প না থাকায় পলিথিনের অতি ব্যবহার ঠেকানো যায়নি। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার পরিবেশ রক্ষায় বিশেষ মনোযোগ দিয়েছে। পলিথিন নিষিদ্ধ আইন কার্যকরের অংশ হিসেবে প্রথম দফায় সুপারশপগুলোতে এ ধরনের ব্যাগের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয় গত ১ অক্টোবর থেকে। আগামী ১ নভেম্বর থেকে রাজধানীর ১০টি কাঁচাবাজারে পলিথিন ব্যবহার বন্ধ হচ্ছে। পরবর্তী ধাপে দেশব্যাপী পলিথিন উৎপাদনকারীদের বিরুদ্ধেও অভিযান চালানো হবে।
এই পরিস্থিতিতে পরিবেশসম্মত ব্যাগের চাহিদা মেটাতে একটি প্রকল্প প্রস্তাব করেছে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়। সম্প্রতি ‘পাট হতে পরিবেশবান্ধব সোনালি ব্যাগ উৎপাদনে টেকসই পদ্ধতি বিস্তৃতির লক্ষ্যে পাইলট কারখানা স্থাপন’ শীর্ষক প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে উপস্থাপনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। গুরুত্ব বিবেচনায় গত সপ্তাহে যাচাই-বাছাইয়ে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিএসই) বৈঠকে বসে পরিকল্পনা কমিশনের সংশ্লিষ্ট শিল্প শক্তি বিভাগ। নীতিগতভাবে একমত হলেও কিছু শর্তের কথা বলা হয় বৈঠকে।
এই সম্পর্কিত প্রকল্প উন্নয়ন প্রস্তাব (ডিপিপি) অনুযায়ী, এক কেজি পাট থেকে এক কেজি সোনালি ব্যাগ উৎপাদন করা সম্ভব। পলিথিন ও সোনালি ব্যাগ তৈরির জন্য ব্যবহৃত কাঁচামাল ও অন্যান্য ব্যয়সহ উৎপাদন খরচ বিবেচনা করলে সোনালি ব্যাগ অর্থনৈতিকভাবে পলিথিনের চেয়ে সাশ্রয়ী হবে। স্থানীয় প্রযুক্তি এবং লোকবল ব্যবহারে উৎপাদন হবে এ ব্যাগ। দাম হবে পলিথিনের দামের কাছাকাছি।
প্রস্তাবনা অনুসারে, আগামী জানুয়ারি থেকে বাণিজ্যিকভাবে সোনালি ব্যাগ উৎপাদন কাজ শুরু হবে। শেষ হবে ২০২৭ সালের ডিসেম্বরে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১০০ কোটি টাকা। পাট মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠান জুট মিলস করপোরেশন (বিজেএমসি) প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে। ডিপিপিতে বলা হয়, এক কেজি পাট থেকে এক কেজি সোনালি ব্যাগ উৎপাদন করা সম্ভব। এক কেজিতে গড়ে ১০০টি ব্যাগ হবে। প্রাথমিকভাবে দিনে ৫ টন সোনালি ব্যাগ উৎপাদন করা হবে।
সোনালি ব্যাগকে পাটের পলিথিনও বলা হয়। এটি মূলত সেলুলোজভিত্তিক বায়োডিগ্রেডেবল বায়োপ্লাস্টিক, যা প্লাস্টিক ব্যাগের একটি বিকল্প। জানতে চাইলে এর আবিষ্কারক ড. মোবারক হোসেন সমকালকে বলেন, পাটের সোনালি ব্যাগ বাণিজ্যিকভাবেও লাভজনক। অনেক আগে আবিষ্কার হলেও এত দিনেও কেন গুরত্বপূর্ণ এ পণ্যটি বাজারজাত হলো না– জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রযুক্তি, উপকরণ সবই হস্তান্তরযোগ্য অবস্থায় আছে। সরকার আন্তরিকভাবে চাইলে পাটের পলিথিন বাণিজ্যিক উৎপাদনের মাধ্যমে বাজারে সহজলভ্য করা যায়। পলিথিন পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সুতরাং পলিথিনের সঙ্গে সোনালি ব্যাগের তুলনা করা উচিত নয়।
বেসরকারি পাটকল মালিকদের সংগঠন বিজেএমইএর মহাসচিব আবদুল বারেক খান সমকালকে বলেন, পাটের প্রতি বিগত সময়ে মন্ত্রণালয়ের অনীহা ছিল। এ কারণে বড় সম্ভাবনা সত্ত্বেও পাট খাত অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারায়। সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী নিজে প্লাস্টিক খাতের ব্যবসায়ী। পাটের প্রতি তাঁর মনোযোগ কম ছিল। পাট নিয়ে নীতি নির্ধারণে একটি উপদেষ্টা কমিটি আছে, যেখানে সব মন্ত্রণালয়, বুয়েট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি থাকেন। পদাধিকার বলে মন্ত্রী ছিলেন কমিটির সভাপতি। বাস্তবতা হচ্ছে, অনেকবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও একবারের জন্যও ওই কমিটির বৈঠক হয়নি। ২০১৭ সালে পাট আইন হয়েছে। অথচ, গত সাত বছরেও বিধিমালা তৈরি করা হয়নি।
প্রসঙ্গত, পলিথিনের বিকল্প পচনশীল ‘সোনালি ব্যাগ’ নামে তৈরির পরীক্ষামূলক প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালে। ঢাকার ডেমরায় লতিফ বাওয়ানি জুট মিলে পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু হয়। সীমিত আকারে কিছু ব্যাগ বাজারজাতও হয়। তবে উৎপাদন ব্যয় বেশি হওয়ায় বাণিজ্যিক উৎপাদন লাভজনক হয়নি। পরের বছর পাট থেকে সোনালি ব্যাগ বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনের জন্য যুক্তরাজ্যভিত্তিক ফিউটামুরা কেমিক্যাল কোম্পানির সঙ্গে বিজেএমসির একটি সমোঝতা স্মারক সই হয়। কিন্তু নানা প্রতিবন্ধকতায় তা আর এগোয়নি।
প্রস্তাবিত প্রকল্পের বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশন বেশ কিছু শর্ত দিয়েছে। যেমন– বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠান দিয়ে প্রকল্পের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রতিবেদনটি পর্যালোচনা করতে হবে। এতে অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ পুনঃপরীক্ষা করতে হবে। যৌক্তিক ব্যয়ের প্রাক্কলনের পাশপাশি নিশ্চিত করতে হবে কাজের গুণগত মান।