ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘পদত্যাগপত্র’ ইস্যুতে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনকে অপসারণে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর চাপ ক্রমেই বাড়ছে। তাকে অপসারণের পদ্ধতি কী হবে তা নিয়ে চলছে আলোচনা। আন্দোলনকারীরা বলছেন, রাষ্ট্রপতি শপথ ভঙ্গ করেছেন, তার আর এ পদে থাকার অধিকার নেই। আন্দোলনের মুখে রাষ্ট্রপতি নিজ থেকে পদত্যাগ করবেন নাকি সরকার তাকে অপসারণের উদ্যোগ নেবে সে অলোচনা চলছে সর্বত্র।
বর্তমান সংবিধানে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলা নেই। সংবিধানের ৫৪ অনুচ্ছেদে বলা আছে, রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হলে কিংবা অনুপস্থিতি, অসুস্থতা বা অন্য কোনো কারণে রাষ্ট্রপতি দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হলে ক্ষেত্রমতো রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত কিংবা রাষ্ট্রপতি পুনরায় স্বীয় কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত স্পিকার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করবেন। ‘শারীরিক বা মানসিক অসামর্থ্যের কারণে’ সংবিধানের ৫৩ অনুচ্ছেদ অনুসারে রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের সুযোগ রয়েছে। তবে, সেক্ষেত্রে তাকে অপসারণ করবে সংসদ।
আইন বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ বলছেন, এখন যেহেতু সংসদ নেই তাই রাষ্ট্রপতিকে সংবিধান মেনে অভিসংশন বা অপসারণের সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার সুপ্রিম কোর্টের কাছে মতামত চাইতে পারে।
তবে রাষ্ট্রপতি স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় পদত্যাগ করলে সংবিধানের ৫৪ অনুচ্ছেদ অনুসারে স্পিকার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করবেন বলে সংবিধানে বলা আছে।
কিন্তু সর্বশেষ সংসদের স্পিকার আগেই পদত্যাগ করেছেন। তাহলে এখন কী হবে? এ বিষয়ে আইনজীবীদের কেউ কেউ বলছেন, ছাত্র-জনতার দাবির পরিপ্রেক্ষিতে যদি রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করেন, ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’ অনুযায়ী তিনি পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেবেন, প্রধান উপদেষ্টা সেটি গ্রহণ করবেন।জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আহসানুল করিম বলেন, শারীরিক বা মানসিক অসামর্থ্যের কারণে সংবিধানের ৫৩ অনুচ্ছেদ অনুসারে রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করা যেতে পারে। তবে তার জন্য সংসদ লাগবে। আর রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে যদি সংবিধান লঙ্ঘন বা অসদাচরণের অভিযোগ ওঠে তখন সংবিধানের ৫২ অনুচ্ছেদ অনুসারে সংসদ তাকে অভিসংশন করতে পারবে। তার জন্য সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের লিখিত অভিযোগ ও প্রস্তাব লাগবে। যেহেতু এখন সংসদ নেই, তাই রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ বা অভিশংসনের কোনো সুযোগ নেই।
পদত্যাগের বিষয়ে এ আইনজীবী বলেন, রাষ্ট্রপতি স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় পদত্যাগ করলে সংবিধানের ৫৪ অনুচ্ছেদ অনুসারে স্পিকার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করবেন। তিনি কার বরাবর পদত্যাগ করবেন সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হচ্ছে পদত্যাগ করার সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা চলে যাবে স্পিকারের কাছে।
স্পিকারও তো পদত্যাগ করেছেন, তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ উঠেছে। এমন পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করলে কে দায়িত্ব পালন করবেন? এ বিষয়ে আইনজীবী আহসানুল করিম বলেন, স্পিকার বা ডেপুটি স্পিকার পদত্যাগ করলেও সংবিধানের ৭৪(৬) অনুচ্ছেদ অনুসারে নতুন কেউ স্পিকার বা ডেপুটি স্পিকারের দায়িত্ব না নেওয়া পর্যন্ত তারা (পদত্যাগকারী স্পিকার বা ডেপুটি স্পিকার) পদে বহাল আছেন বলে গণ্য করা হবে। ফলে সংসদ না থাকলেও, সংসদ সদস্য পদ না থাকলেও তাদেরই স্পিকার বা ডেপুটি স্পিকার পদের দায়িত্ব পালন করতে হবে।
কার কাছে পদত্যাগ করবেন সেটি বড় কথা নয়, বড় কথা হচ্ছে তিনি পদত্যাগ করতে পারেন— এমন মন্তব্য করে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, আমরা দেখেছি রাষ্ট্রপতি তিন বাহিনীর প্রধানকে পেছনে রেখে বলেছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন এবং তিনি সেটি গ্রহণ করেছেন। পরবর্তী সময়ে আমরা দেখলাম সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের শপথ পড়ানোর বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের কাছে মতামত চাইতে। সাবেক প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের বিচারপতিরা ইতিবাচক পরামর্শ দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের রাজনীতি এতদূর গড়িয়ে যাওয়ার পর এখন তিনি বলছেন তার কাছে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগপত্র নেই। তার এই বক্তব্যের পর দেশের বিভিন্ন মহলে বেশ প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে।
ব্যারিস্টার কাজল বলেন, গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের মতামতের ভিত্তিতে। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর রাষ্ট্রপতি অন্তর্বর্তী সরকার অধ্যাদেশ জারি করেছেন। রাষ্ট্রপতি কার কাছে পদত্যাগ করবেন সেটি বড় কথা না, বড় কথা হচ্ছে তিনি পদত্যাগ করতে পারেন। এই পদত্যাগের জন্য কাউকে অ্যাড্রেস (কারো বরাবর) করে পদত্যাগ করার বিষয় এই মুহূর্তে নাই। কথা হচ্ছে- যখন কিছু (প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভা, সংসদ) ছিল না তখন কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়েছে। এটি ডকট্রিন অব নেসিসিটি (বাস্তবতার নিরিখে বা সময়ের প্রয়োজনে)। আমি মনে করি অন্তর্বর্তী সরকারও বাস্তবতার নিরিখে এবং রাজনৈতিক সমঝোতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। যেটি ১৯৯১ সালে এরশাদের পতনের পর হয়েছিল।
রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করলে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা রাষ্ট্রপতি পদে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন কি না, এমন প্রশ্নে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সমিতির সাবেক এই নেতা বলেন, এমন একটা পরিস্থিতি বলতে বাধ্য হচ্ছি, জরুরি অবস্থার সময় সংবিধান স্থগিত করা হয়। বর্তমান যে অবস্থা, সে অবস্থায় সংবিধান কিন্তু স্থগিত করা হয়নি। সংবিধানের কাছাকাছি থেকে রাষ্ট্র পরিচালিত হচ্ছে, একথা বললে কিন্তু ভুল হবে না। সরকার ইতোমধ্যে সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। আবার সুপ্রিম কোর্ট বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী চলছে। সময়ের প্রয়োজনে এমন (প্রধান উপদেষ্টা এবং একই সঙ্গে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করা) আইনি কাঠামো তৈরি করা যেতে পারে। তবে সেটা ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতার ভিত্তিতে হতে হবে।
এই আইনজীবী আরও বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে যেকোনো যোগ্য ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতি করা যেতে পারে। যেমনটি এরশাদ পতনের পর বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে নির্বাচিত সরকার সেই সরকারের সাংবিধানিক বৈধতা দিয়েছিলেন।
সংবিধানে কী বলা আছে?
রাষ্ট্রপতির অভিশংসন নিয়ে সংবিধানের ৫২ (১) অনুচ্ছেদে বলা আছে- ‘এই সংবিধান লঙ্ঘন বা গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগে রাষ্ট্রপতিকে অভিশংসিত করা যাইতে পারিবে; ইহার জন্য সংসদের মোট সদস্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের স্বাক্ষরে অনুরূপ অভিযোগের বিবরণ লিপিবদ্ধ করিয়া একটি প্রস্তাবের নোটিশ স্পিকারের কাছে দিতে হইবে; স্পিকারের নিকট অনুরূপ নোটিশ প্রদানের দিন হইতে চৌদ্দ দিনের পূর্বে বা ত্রিশ দিনের পর এই প্রস্তাব আলোচিত হইতে পারিবে না; এবং সংসদ অধিবেশনরত না থাকিলে স্পিকার অবিলম্বে সংসদ আহ্বান করিবেন।’
অসামর্থ্যের কারণে রাষ্ট্রপতির অপসারণের বিষয়ে সংবিধানের ৫৩ (১) অনুচ্ছেদে বলা আছে- ‘শারীরিক বা মানসিক অসামর্থ্যের কারণে রাষ্ট্রপতিকে তাহার পদ হইতে অপসারিত করা যাইতে পারিবে; ইহার জন্য সংসদের মোট সদস্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের স্বাক্ষরে কথিত অসামর্থ্যের বিবরণ লিপিবদ্ধ করিয়া একটি প্রস্তাবের নোটিশ স্পিকারের নিকট প্রদান করিতে হইবে।’
এই অনুচ্ছেদের (২) উপঅনুচ্ছেদে বলা আছে— সংসদ অধিবেশনরত না থাকিলে নোটিশ প্রাপ্তিমাত্র স্পিকার সংসদের অধিবেশন আহ্বান করিবেন এবং একটি চিকিৎসা-পর্ষদ (অতঃপর এই অনুচ্ছেদে “পর্ষদ” বলিয়া অভিহিত) গঠনের প্রস্তাব আহ্বান করিবেন এবং প্রয়োজনীয় প্রস্তাব উত্থাপিত ও গৃহীত হইবার পর স্পিকার তৎক্ষণাৎ ওই নোটিশের একটি প্রতিলিপি রাষ্ট্রপতির নিকট প্রেরণের ব্যবস্থা করিবেন এবং তাহার সহিত এই মর্মে স্বাক্ষরযুক্ত অনুরোধ জ্ঞাপন করিবেন যে, অনুরূপ অনুরোধ জ্ঞাপনের তারিখ হইতে দশ দিনের মধ্যে রাষ্ট্রপতি যেন পর্ষদের নিকট পরীক্ষিত হইবার জন্য উপস্থিত হন।’
আর সংবিধানের ৫৪ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- ‘রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হইলে কিংবা অনুপস্থিতি, অসুস্থতা বা অন্য কোনো কারণে রাষ্ট্রপতি দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হইলে ক্ষেত্রমত রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত কিংবা রাষ্ট্রপতি পুনরায় স্বীয় কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত স্পিকার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করিবেন।’
স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার সংক্রান্ত সংবিধানের ৭৪(৬) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে— ‘এই অনুচ্ছেদের (২) দফার বিধানাবলি সত্ত্বেও ক্ষেত্রমত স্পিকার বা ডেপুটি স্পিকার তাহার উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত স্বীয় পদে বহাল রহিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে।
যে বক্তব্য ঘিরে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ দাবি
রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন মানবজমিন পত্রিকার প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীকে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে বলেন, তিনি শুনেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন, কিন্তু তার কাছে এ সংক্রান্ত কোনো দালিলিক প্রমাণ বা নথিপত্র নেই।
সাক্ষাৎকারটি ১৯ অক্টোবর মানবজমিন পত্রিকাটির রাজনৈতিক ম্যাগাজিন সংস্করণ ‘জনতার চোখ’-এ প্রকাশিত হয়।
মতিউর রহমান চৌধুরীর মতে, প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগপত্র যদি সত্যিই জমা দেওয়া হয়, তাহলে সেটির অনুলিপি কারও না কারও কাছে থাকার কথা। কিন্তু তিন সপ্তাহ ধরে বিভিন্ন জায়গায় অনুসন্ধান চালালেও এর খোঁজ কেউ দিতে পারেনি তাকে। এমনকি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগেও যোগাযোগ করা হয়েছে, যেখানে সাধারণত রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীদের পদত্যাগপত্র সংরক্ষিত থাকে। কিন্তু সেখানেও কিছু পাওয়া যায়নি। তাই শেষমেশ রাষ্ট্রপতির কাছেই সরাসরি এর উত্তর জানার সুযোগ মেলে।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র আন্দোলন ও গণবিক্ষোভের মুখে দেশত্যাগ করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সংবিধানের ৫৭ (ক) ধারা অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করলে রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিতে হবে। কিন্তু রাষ্ট্রপতি জানিয়েছেন, তার কাছে শেখ হাসিনার কোনো পদত্যাগপত্র বা সংশ্লিষ্ট কোনো প্রমাণ পৌঁছায়নি।
রাষ্ট্রপতির ভাষ্যমতে, ‘আমি বহুবার পদত্যাগপত্র সংগ্রহের চেষ্টা করেছি, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছি। হয়ত তার সময় হয়নি।’
এমএইচডি/এসএম