বকেয়া পরিশোধের জন্য আদানি পাওয়ারের সময় বেঁধে দেওয়ার খবরে বাংলাদেশে প্রতিক্রিয়া হওয়ার পর ভারতীয় ওই বেসরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানি বলেছে, প্রায় ৮৫ কোটি ডলারের বকেয়ার পুরোটা তারা ৭ নভেম্বরের মধ্যে চায়নি।
রোববার সন্ধ্যায় একটি পিআর ফার্মের মাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে আদানি পাওয়ার বলেছে, “আদানি সাত দিনের মধ্যে ৮০ থেকে ৮৫ কোটি ডলারের পূর্ণ পেমেন্ট দাবি করেনি। বিষয়টির সমাধানে আদানি বাংলাদেশের পিডিবির সঙ্গে পূর্ণ সহযোগিতা করছে।”
আদানি গ্রুপের কোম্পানি আদানি পাওয়ার ২৫ বছর মেয়াদি চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (পিডিবি) বিদ্যুৎ দিচ্ছে। গত বছরের মার্চ থেকে ভারতের ঝাড়খণ্ডের গড্ডায় আদানির ১৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে এই বিদ্যুৎ বাংলাদেশে আসছে।
আদানি পাওয়ার প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের জন্য বাংলাদেশের কাছ থেকে প্রায় ১২ টাকা করে নেয়। এই দর ভারতের অন্যান্য বেসরকারি উৎপাদকের দরের তুলনায় ২৭ শতাংশ বেশি এবং ভারতীয় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কেন্দ্রগুলোর তুলনায় ৬৩ শতাংশ বেশি।
বিষয়টি নিয়ে গত সরকারের আমলেই প্রশ্ন উঠেছিল, কিন্তু তার সুরাহা হয়নি। আর আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে চাহিদার প্রায় এক দশমাংশ বিদ্যুৎ পাচ্ছে বাংলাদেশ, ফলে রাতারাতি চুক্তি বাতিল করাও সরকারের জন্য ‘কঠিন’।
এদিকে ডলার সংকটের কারণে গত সরকারের সময় থেকেই আদানির বিপুল অঙ্কের বিল বকেয়া পড়ে গেছে। সেই অঙ্ক ইতোমধ্যে ৮৫ কোটি ডলারে পৌঁছেছে বলে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর খবর। বকেয়া আদায়ে কিছুদিন পরপরই বাংলাদেশে ছুটে আসছেন আদানির প্রতিনিধিরা।
গড্ডার বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দুটি ইউনিট থেকে প্রতিদিন ১৪০০ থেকে ১৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বাংলাদেশে আসছিল। বকেয়া না পাওয়ায় গত বৃহস্পতিবার একটি ইউনিটের বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ করে দেয় আদানি।
বকেয়া অর্থ পরিশোধের জন্য ৩১ অক্টোবর সময়সীমা বেঁধে দিয়ে ১৭ কোটি ডলারের ঋণপত্র (এলসি) পরিশোধ করতে বলেছিল আদানি পাওয়ার। চুক্তি অনুযায়ী আদানিকে সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে অর্থ পরিশোধ করার কথা বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের।
তবে ডলার সংকটের কারণে ব্যাংকটি অপারগতা প্রকাশ করায় সেই অর্থ কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা পাঠাতে চেয়েছিলেন বলে সূত্রের বরাতে লিখেছে টাইমস অব ইন্ডিয়া। তবে তা চুক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হওয়ায় আদানি পাওয়ার তাতে সম্মতি দেয়নি।
এ পরিস্থিতিতে আদানি পাওয়ার একটি ইউনিট বন্ধ করে দেওয়ায় বাংলাদেশের চলমান লোড শেডিং আরও বেড়েছে। পাওয়ার গ্রিড বাংলাদেশের (পিজিবি) ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, শুক্রবার ৭২৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ দিয়েছে ভারতীয় ওই কোম্পানি।
এর মধ্যেই টাইমস অব ইন্ডিয়া রোববার খবর দেয়, বকেয়া নিষ্পত্তির সুরাহা না হলে আদানি পাওয়ার আগামী ৭ নভেম্বর থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেবে।
ওই খবর বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে আসার পর প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা অক্টোবর মাসে ওদেরকে (আদানি পাওয়ার) প্রায় ৯৮ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করেছি; সেপ্টেম্বরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ।
“এছাড়া তাদের জন্য বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে ১৭ কোটি ডলারের এলসি করা হয়েছে। তারপরও তাদের এমন আচরণ খুব আশ্চর্যজনক, বিস্ময়কর এবং দুঃখজনক।”
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আদানি যদি সত্যিই বিদ্যুৎ বন্ধ করে দেয়, তাহলে আমরা এটা মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত আছি। গ্রাহকরা যাতে ভোগান্তির মধ্যে না পড়ে, সেজন্য আমরা বিকল্প ব্যবস্থা নিচ্ছি।”
‘হতাশ, হতবাক’
বকেয়া পরিশোধে আদানির সময় বেঁধে দেওয়ার যে খবর সংবাদমাধ্যমে এসেছে, তাতে হতাশা প্রকাশ করেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলমও।
রোববার বিকালে ঢাকার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, “আদানির ওই পুরো চিঠিটি এখনো জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে আসেনি। এটা যদি সত্য হয়, উই আর ডিসমেইড অ্যান্ড উই আর শকড।”
প্রেস সচিব বলেন, “বিদ্যুৎ আমদানির জন্য ভারতের আদানি গ্রুপ টাকা পায়, এটা সত্য। তাদের পেমেন্ট দেওয়ার ক্ষেত্রে গতি বাড়িয়েছি। যে ব্যাকলগ (বকেয়া) আছে সেটার জন্য মূলত দায়ী পূর্ববর্তী স্বৈরশাসক । তারা বিশাল একটা ব্যাকলগ রেখে গেছে, সেটার কারণে এটা বেড়ে গেছে।
“আদানি গ্রুপকে গত মাসে ৯৭ মিলিয়ন ডলার পেমেন্ট করা হয়েছে, যেটা আগের মাসের চেয়ে দ্বিগুণ। আমাদের তরফ থেকে সর্বোচ্চ পাওনা পরিশোধ আরও দ্রুত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দেশের রিজার্ভ বাড়া শুরু হয়েছে, আন্তজার্তিক পেমেন্টগুলো রিজার্ভে হাত না দিয়েই করতে পারছি। পেমেন্ট ৭০০ মিলিয়ন ডলার বাকি আছে। সেটাও দ্রুত সময়ের মধ্যে করে দিতে পারব।”
শফিকুল আলম বলেন, “সত্যিকার অর্থে আমরা কারো দ্বারা হোস্টেজ হব না। উই উইল নট বি হোস্টেজ টু অ্যানি ইনডিভিজুয়াল পাওয়ার প্রডিউসার। নো ম্যাটার হাউ পাওয়ারফুল দে আর।”
প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার ও অপূর্ব জাহাঙ্গীরও ব্রিফিংয়ে উপস্থিত ছিলেন।
অর্থ পাচার
বিগত সরকারের সময় বছরের ১৬-১৮ বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে— টিআইবির নির্বাহী পরিচালকের এমন বক্তব্যর বিষয়ে ব্রিফিংয়ে প্রেস সচিবের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন একজন সাংবাদিক।
জবাবে শফিকুল আলম বলেন, “টাকা পাচার বিষয়ে আমাদের যথেষ্ট এফোর্ট আছে, অধ্যাপক ইউনূস নিউ ইয়র্কে গিয়েছিলেন, সেখানে এ বিষয়ে কথা হয়েছে। বিভিন্ন রাষ্ট্রপ্রধান, বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ এর সঙ্গে আলোচনায় মূল এজেন্ডা ছিল এটা।
“বাংলাদেশের বিভিন্ন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গেও এ বিষয়ে আলাপ করেছেন। আমরা আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। এটি নিয়ে বিএফআইইউ কাজ করছে। এ বিষয়ে এফবিআইর সঙ্গে কথা হয়েছে। এটা খুবই কঠিন একটি কাজ। কিন্তু আমরা আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করব যে করেই হোক এই টাকাটা আনা যায়। এটা বাংলাদেশের মানুষের টাকা। আশা করি এই টাকা বাংলাদেশে ফিরলে মানুষের কল্যাণে ব্যয় করা যাবে।’’
ব্যাংক খাত ও আর্থিক খাতের দুর্নীতির তদন্ত সংক্রান্ত এক প্রশ্নে জবাবে শফিকুল আলম বলেন, ‘‘এই পুরো বিষয়টি সামনে আনার জন্যই শ্বেতপত্র কমিটি করা হয়েছে। খুবই শক্তিশালী একটি কমিটি। যে পরিমাণ অনাচার হয়েছে, যে পরিমাণ করাপশন হয়েছে সেটি শুধু বিভিন্ন প্রকল্প গুলোতেই না, ব্যাংকগুলোতেও ম্যাসিভ লুটপাট হয়েছে, সেই লুটপাটের চিত্রটি কমিটির প্রতিবেদনে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাবে।”
‘শোকাবহ’ ৩ নভেম্বর
আরেক প্রশ্নের জবাবে প্রেস সচিব বলেন, “আজ ৩ নভেম্বর। এটি খুবই শোকাবহ দিন। তাজউদ্দিন আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কামরুজ্জামান এবং ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এরা আমাদের স্বাধানীতা যুদ্ধের সময় যে সরকার ছিল, তারা এখানে খুবই বড় ভূমিকা পালন করেছেন।”
১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর ৩ নভেম্বর মধ্যরাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠে জাতীয় চার নেতা বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ, মন্ত্রিসভার সদস্য ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এএইচএম কামরুজ্জামানকে নির্মম ও নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়।
কারাগারের নিরাপদ আশ্রয়ে থাকা অবস্থায় বর্বরোচিত এমন হত্যাকাণ্ড পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।
শফিকুল আলম বলেন, “বাংলাদেশ নয় মাসে যুদ্ধ করে বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল, তাতে উনাদের ভূমিকা অনেক। আমরা তাদেরকে চিরকৃতজ্ঞভাবে স্মরণ করি। এই ঘটনা আওয়ামী সরকার এতকাল লুকিয়ে রেখেছিল, এটার মূল ইস্যু ছিল তারা একজনকে কাল্ট তৈরি করতে চেয়েছিল। দেখাতে চেয়েছিল বাংলাদেশের সমস্ত কিছুই একজনের জন্য হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে তাজউদ্দিন আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ চার নেতাদের অবদান অনেক। আমরা তাদের অবদান স্বীকার করি।’’
জাতীয় পার্টির কার্যালয়ে হামলার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে উপ-প্রেস সচিব মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ মজুমদার বলেছেন, “বর্তমান সরকার কোনো রাজনৈতিক সহিংসতায় বিশ্বাস করে না। জাতীয় পার্টির ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত হবে সেটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। রাজনৈতিক দলগুলো সঙ্গে আলোচনা, মতামত ও ঐকমত্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আপাতত কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।
“জাতীয় পার্টির কার্যালয়ে হামলার বিষয়টি পুলিশ তদন্ত করছে। আমরা যে কোনো সহিংসতার প্রতিবাদ করি। আমরা চাই না দেশে কোন ধরনের সহিংসতা হোক।”