বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ন্যক্কারজনক ও ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। তবে সবচেয়ে ভয়াবহ হচ্ছে গুম-অপহরণের ঘটনা। কথাটি বলা হলো এ কারণে যে, যারা হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন, তাদের স্বজনরা মরদেহ হাতে পেয়ে বিচারহীনতার কষ্ট নিয়ে দিনযাপন করার সুযোগ পেয়েছেন; কিন্তু যারা গুমের শিকার হয়েছেন, তাদের স্বজনরা তো জানতেই পারেননি তাদের প্রিয় মানুষটির কী পরিণতি হয়েছে। এটা যে কতখানি অনিশ্চয়তা, আতঙ্ক ও কষ্টের, তা শুধু ভুক্তভোগীই জানেন। অন্তর্বর্তী সরকার এ বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগের শাসনামলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধানে পাঁচ সদস্যের কমিশন গঠন করেছে। মঙ্গলবার জারি করা এ সংক্রান্ত এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ‘কমিশন অব ইনকোয়ারি অ্যাক্ট, ১৯৫৬’ অনুসারে তদন্তকাজ সম্পন্ন করে কমিশনকে আগামী ৪৫ কার্যদিবসের মধ্যে সরকারের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে হবে। এতে আরও বলা হয়, আইনশৃঙ্খলা প্রয়োগকারী সংস্থা তথা বাংলাদেশ পুলিশ, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব), বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ, অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), বিশেষ শাখা, গোয়েন্দা শাখা, আনসার ব্যাটালিয়ন, জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই), প্রতিরক্ষা বাহিনী, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর (ডিজিএফআই), কোস্ট গার্ডসহ দেশের আইন প্রয়োগ ও বলবৎকারী কোনো সংস্থার কোনো সদস্যের মাধ্যমে জোরপূর্বক গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধানের জন্য এ তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সম্প্রতি আয়নাঘরসহ গুম-খুনের নানা তথ্য বেরিয়ে আসায় এটা স্পষ্ট যে, বিগত সরকারের সময়ে রাষ্ট্রীয় ইন্ধনে এ ধরনের অপরাধপ্রবণ ব্যক্তিরা এতটাই বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল যে, তারা কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করত না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তাদের দায়িত্বের বিপরীতে ব্যবহার করা হয়েছে। সন্দেহ নেই, তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের নৈতিক অবক্ষয় মারাত্মক আকারে ঘটেছিল বলেই রাজনৈতিক ও অন্যান্য স্বার্থের কারণে বিরোধী মত দমনে গুম-খুন করতেও তারা দ্বিধা করেনি। বিগত সরকারের অপরাধের এসব পৌনঃপুনিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গুমের শিকার ব্যক্তিদের সন্ধানে অন্তর্বর্তী সরকারের বিশেষ কমিশন গঠনের পদক্ষেপ সময়োচিত, সন্দেহ নেই। স্বাভাবিকভাবেই ধামাচাপা দিয়ে রাখা প্রতিটি গুম-খুনের ঘটনার উদ্ঘাটন জরুরি হয়ে পড়েছে। বস্তুত সে সময় ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ক্ষমতার লোভে বিবেকবর্জিত হয়ে পড়েছিলেন বলেই তারা বেআইনি বা নীতিবহির্ভূত কর্মকাণ্ডের মাঝে আশ্রয় খুঁজে নিয়েছিলেন।
দেশে গত ১৫ বছরে যেসব গুম-খুনের ঘটনা ঘটেছে, আমরা তার প্রতিটির রহস্য উদ্ঘাটনের দাবিই শুধু করছি না, উদ্ঘাটিত সব তথ্য জাতির সামনে প্রকাশের আহ্বানও জানাচ্ছি। একরামুল হক, মেজর (অব.) সিনহা রাশেদ খানসহ যারাই সে সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে খুনের শিকার হয়েছেন, তাদের স্বজনদের ক্ষতিপূরণ প্রদানসহ অপরাধে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি। শুধু তাই নয়, যারা এর পেছনে নির্দেশদাতা ছিল, যাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে দেশে এমন ভয়ের পরিবেশ তৈরি হয়েছিল, তাদের প্রত্যেককেই বিচারের আওতায় আনা উচিত। আশার কথা, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। প্রত্যাশা থাকবে, অন্তর্বর্তী সরকার ৫ আগস্টের পূর্ব ও পরবর্তী সব হত্যাকাণ্ডেরই কেস টু কেস তদন্তপূর্বক দ্রুততর সময়ে দায়ীদের চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।