অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেয়ার পর এক মাস পূর্ণ হয়েছে। পতিত স্বৈরাচারী সরকার দেশ ও দেশের প্রতিষ্ঠানসমূহ সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়ে গেছে তার সাড়ে ১৫ বছরের দুঃশাসনে। রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপক ও অর্থবহ সংস্কার ছাড়া কার্যকর ও গতিশীল করা প্রায় অসম্ভব। পুলিশ এতটাই দলদাস ও দুর্বৃত্তাচারে মত্ত হয়ে পড়ে যে, তার প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা নিঃশেষ হয়ে যায়। তার ঘাতক ভূমিকা গণআস্থাকে একেবারে তলানিতে নামিয়ে দেয়। প্রশাসনও দলীয়করণের বিষবাষ্পে পুরোপুরি আচ্ছন্ন। এমতাবস্থায়, শুরুতেই অন্তর্বর্তী সরকারকে বেকায়দায় পড়তে হয়। পুলিশ কর্মবিরতির নামে অসহযোগিতা প্রদর্শন করে। প্রশাসনও নিষ্ক্রিয় অবস্থানে নিজেকে আটকে রাখে। সরকার পুলিশ ও প্রশাসনকে রদবদলের মাধ্যমে ইতোমধ্যে কিছুটা সক্রিয় করে তুলেছে। পতিত স্বৈরাচারী সরকার অর্থনীতিকে ফোকলা করে দিয়েছে। ফলে তার পুনরুদ্ধারে সরকারকে কিছু উদ্যোগ-পদক্ষেপ নিতে হয়েছে। এর মধ্যে ব্যাংকখাত সংস্কারে কমিশন গঠন, অর্থনীতির চিত্র তুলে আনতে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠন, পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারের উদ্যোগ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। সরকারি কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব চাওয়া, গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধানে কমিশন গঠন, মূল্যস্ফীতি কমাতে আমদানি শুল্ক হ্রাস, শিল্পক্ষেত্রে শান্তি-শৃংখলা রক্ষায় বিশেষ ব্যবস্থার কথাও উল্লেখ করা যায়। বলা বাহুল্য, এগুলো সবই গঠনমূলক ও জরুরি কাজ। সরকার নতুন বাংলাদেশ গঠনে এবং ছাত্র-জনতার স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নে ক্ষমতায় এসেছে। শুরু থেকে তাকে পতিত স্বৈরাচার ও তার প্রভূ ভারতের একের পর এক ষড়যন্ত্রের মুখে পড়তে হয়েছে। সাময়িক-বেসামরিক ক্যুর মাধ্যমে সরকারকে ফেলে দেয়ার অপচেষ্টা হয়েছে। সামরিক বাহিনীর গাড়িতে হামলা, জুডিশিয়াল ক্যুর চেষ্টা, সংখ্যালঘু নির্যাতনের ফানুস ওড়ানো, আনসার বিদ্রোহের অপপ্রয়াস, ১৫ আগস্ট পাল্টা গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণা, দাবি-দাওয়া ও আন্দোলনের নামে বিশৃংখলা সৃষ্টি, শিল্পাঞ্চলে পরিকল্পিত হামলা ইত্যাদির কথা এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে। সরকারকে এসব দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র চক্রান্ত মোকাবিলা করতে হয়েছে। সরকারের যথাযথ উদ্যোগ, কৌশল ও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে ছাত্র-জনতার পূর্ণ সহযোগিতা ও পদক্ষেপ চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রকে ব্যর্থ করে দিয়েছে।একথা মনে করার কারণ নেই, দিল্লীতে বসে পতিত স্বৈরাচারের ষড়যন্ত্রের ঘুঁটি চালাচালি বন্ধ হয়ে গেছে। তার প্রতি অন্ধ মোদি সরকার তাকে পুনর্বাসিত করার চেষ্টা পরিত্যাগ করেছে, এটাও ভাবার কারণ নেই। হাসিনা-মোদির চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র লাগাতার চলছে এবং চলবে বলেই পর্যবেক্ষকদের অভিমত। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেছেন, সরকারের বিরুদ্ধে একের পর এক ক্যু হয়েছে। আরো হতে পারে। তিনি আরো বলেছেন, আমাদের আন্দোলন শেষ হয়নি। আন্দোলন অব্যাহত রাখতে হবে। তার এ বক্তব্যের সারবত্তা প্রণিধানযোগ্য। এটা সত্য, অন্তর্বর্তী সরকারকে দ্বিতীয় স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়নে যেমন কাজ করতে হবে, তেমনি হাসিনা-মোদির চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রও সফলভাবে মোকাবিলা করতে হবে। সরকারের প্রধান শক্তি দেশের ছাত্র-তরুণ। তাদের পেছনে আছে কোটি কোটি মানুষের মিছিল। এই ছাত্র-জনতা যদি ঐক্যবদ্ধ থাকে, সক্রিয় থাকে, তাহলে কোনো চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রই সফল হবে না। শুধু চক্রান্ত ষড়যন্ত্র নয়, আমাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নেও ছাত্র-জনতাকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। লক্ষ্য অর্জনে আন্দোলন অব্যাহত রাখতে হবে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সংগঠক ও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের ছাত্র প্রতিনিধিদের উদ্দেশ্যে গত রোববার যে বক্তব্য দিয়েছেন তা একাধারে রাষ্ট্রনায়কোচিত, গুরুত্বপূর্ণ ও দিকনির্দেশক। আন্দোলন অব্যাহত রাখার বা দেশের কাজের সঙ্গে ছাত্রদের সম্পৃক্ত থাকার ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেছেন, ‘ছাত্র-জনতার আকাক্সক্ষার যে স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার কাজ শুরু হয়েছে, তা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তোমরা এর থেকে বেরিয়ে যেয়ো না।’ বলার অপেক্ষা রাখে না, তিনি দেশ গড়ার জন্য ছাত্র-তরুণদেরই সবচেয়ে কার্যকর শক্তি হিসেবে বিবেচনা করেন। তিনি অশিতিপর একজন মানুষ, কিন্তু তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছাত্র-তরুণদের সঙ্গেই। ছাত্র-তরুণদের সক্ষমতার ব্যাপারে তার কোনো সন্দেহ-সংশয় নেই। আমাদের ছাত্র-তরুণরা স্বৈরাচারের পতন ও বিতাড়নের মধ্য দিয়ে অভূতপূর্ব ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। এতে তাদের শক্তিমত্তাতার প্রমাণ রয়েছে। দেশ নির্মাণ ও গঠনে তাদের প্রয়োজন সর্বাধিক। পতিত স্বৈরাচারের চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রের প্রতি ইঙ্গিত করে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, তারা চুপচাপ থাকবে না। তারা তোমাদের দুঃস্বপ্নের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়ার চেষ্টা করবে। কাজেই তোমাদের শুরু করা কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত থাকতে হবে। বিপ্লবের মন্ত্র ধরে রাখার জন্য তাকিদ দিয়েছেন তিনি। এ মন্ত্র থেকে সরে গেলে অশেষ দুর্গতি নেমে আসবে, এমন হুঁশিয়ারি দিতেও ভোলেননি। ছাত্রদের রাজনৈতিক দল গঠন করার বিষয়ে নিরুৎসাহিত করেছেন প্রধান উপদেষ্টা। এটা করলে এখন তাদের যে সর্বব্যাপী গ্রহণযোগ্যতা আছে তা আর থাকবে না। ড. মুহাম্মদ ইউনূস নতুন বাংলাদেশ গঠনে খুবই আশাবাদী। এজন্য ছাত্র-তরুণসহ দেশবাসীর পূর্ণ সমর্থন ও উদ্যোগের বিকল্প নেই। তার মতে, একটা সুযোগ এসেছে রাষ্ট্র গঠনে। সেটা হারানো যাবে না, হারালে ভবিষ্যৎ থাকবে না।
এখন জাতিকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। ধৈর্য ধারণ করতে হবে সবাইকে। পতিত স্বৈরাচার ও তার প্রভূর চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র ঐক্যের শক্তিতে, সংহতির বলে ব্যর্থ করে দিতে হবে। দাবি-দাওয়া থাকতেই পারে, তবে তা অর্জনের জন্য চক্রান্তকারীদের পাতা ফাঁদে পা দেয়া যাবে না। দেশের জন্য এখন অনেক কাজ করতে হবে। এতদিনে জাতির যা কিছু অর্জন, পতিত স্বৈরাচার তা ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। এখন রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্রাচার, গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও সুশাসন সব ক্ষেত্রে কাজ করতে হবে। পতিত স্বৈরাচারের চর-অনুচররা এখনো সামরিক-বেসামরিক বাহিনী, প্রতিষ্ঠান, মন্ত্রণালয়, দফতর, অধিদফতর, আদালত ইত্যাদিতে রং বদল করে বা ঘাপটি মেরে বসে আছে। এদের বহাল রেখে এই বিশাল সংস্কার কাজ সম্পন্ন করা যাবে না। সর্বক্ষেত্রেই শুদ্ধি অভিযান চালাতে হবে। স্বৈরাচারের দোসরদের বিতাড়িত করতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারকে একাজে সমর্থন ও সহযোগিতা দিতে হবে। ছাত্র-জনতার সংহতি, রাজনৈতিক দলগুলোর সহায়তা অটুট থাকলে ছাত্র-জনতার স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষা বাস্তবায়িত হবে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি শিক্ষিত, দক্ষ, অভিজ্ঞ টিম অন্তর্বর্তী সরকারে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার জনগণের চাহিদা ও প্রয়োজন সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল, ইতোমধ্যে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলোতে তার প্রতিফলন রয়েছে। বলা মাত্র সবকিছু হয়ে যাবে না। সমস্যাগুলো অনেক কঠিন ও জটিল। নজির হিসেবে আর্থিক খাতের কথা বলা যেতে পারে। অর্থনীতি, ব্যাংকব্যবস্থা, বিনিয়োগ, রিজার্ভ, ডলার, দুর্নীতি, চুরি, পাচার ইত্যাদি মিলে যে পরিস্থিতি, তা কি দ্রুত ও সহজে সমাধানযোগ্য? এসব ক্ষেত্রে পুনর্গঠন, সংস্কার ও যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার পর প্রত্যাশিত সুফল পাওয়া যাবে। সে পর্যন্ত ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা প্রদর্শন করতে হবে।