অন্তর্বর্তী সরকারের এক মাস পূর্তির প্রাক্কালে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস সম্প্রতি আশা করেছেন যে, শিক্ষার্থীরা এখন স্ব-স্ব শিক্ষালয়ে ফেরত যাবে। তিনি বলেছেন, কোনও জাতি লেখাপড়া ছাড়া উন্নতি করতে পারে না। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়ে হাজারখানেক ছাত্র-জনতা নিহত হয়েছে, আর আহত হয়েছে কয়েক হাজার। অনেক ছাত্র ও লোক জীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেছে। যারা প্রাণ হারিয়েছে এবং যারা আহত হয়েছে তাদের সবার ত্যাগ জাতি হয়তো কোনও দিন শোধ করতে পারবে না; কিন্তু যে কোনও বিপ্লবের পর দেশ যখন পুনরায় থিতু হতে থাকে তখন আশা করা যায় যে, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার চাকাও সচল হবে।
তবে মুগ্ধের যমজ ভাই স্নিগ্ধ, সে কীভাবে ফিরে আসবে শিক্ষালয়ে? মুগ্ধ ‘পানি লাগবে, পানি’ করে যখন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের জগে করে পানি খাওয়াচ্ছিল, তখন তার গায়ে গুলি লাগে, সে মারা যায়। স্নিগ্ধ এখন বলছে, ওকে ছাড়া আমি বাঁচব কীভাবে?
স্নিগ্ধের অনুভূতিটা আমাদের সবার। একটা সংসারের খবর দেখলাম টিভিতে। হাত কাটা গেঞ্জি গায়ে মধ্যবয়ষ্ক এক শ্রমিক শুয়ে আছেন বিছানায়। তার ডান হাত বাজু থেকে বিচ্ছিন্ন, আর অন্য হাতে কোপানি খাওয়ার পর আঘাতের ওপর লম্বা বিছা-সেলাই। তার পাশে তার দুটি শিশু ফ্যালফ্যাল করে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আছে। বিছানার শেষ প্রান্তে লোকটির স্ত্রী গভীর বিষাদে ঠোঁট কামড়াচ্ছে। সংসার নামক এই গভীর অতলান্ত সাগর এই দরিদ্র পরিবার কীভাবে পাড়ি দেবে?
আরেকটি খবরে জানতে পারছি, একটা যুবক ছেলে, যে নাকি আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল সে দিন-রাত এক মুহূর্তের জন্যও ঘুমোতে পারে না। তখন বন্ধুদের খোলা বুকে বন্দুকের গুলি নেওয়ার দৃশ্য মনে পড়ে, আর কানে বাজতে থাকে সাউন্ড গ্রেনেডের ভয়াবহ শব্দ।
বুঝতে পারছি না, এই জেন জেড প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা আবার কীভাবে শিক্ষালয়ে ফেরত এসে পড়াশোনা শুরু করতে পারবে! আবার অন্যদিকে বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষদের অনেকেই নিজ নিজ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী দ্বারা নিগৃহীত হয়ে চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন এবং অনেক শিক্ষালয়ের সাধারণ শিক্ষকদের অনেকেই শিক্ষার্থী দ্বারা নাজেহাল হয়েছেন। আবার উল্টো চিত্রও দেখা যাচ্ছে যে, বিতাড়িত শিক্ষকদের অনেককেই আবার একই শিক্ষার্থীগোষ্ঠী গলায় ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে শিক্ষাঙ্গনে প্রবেশ করাচ্ছে।
চালচিত্র যা-ই হোক, মোদ্দা কথা হলো- শিক্ষাঙ্গনগুলোকে পূর্ণোদ্যমে চালু করতে হবে। তাই এখন বিপ্লবোত্তর পরিস্থিতিতে, প্রধান উপদেষ্টার আহ্বানের পরিপ্রেক্ষিতে, শিক্ষালয়ে শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে কিছু চিন্তার অবতারণা করছি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সফলতার মূল সুরটাকে যদি একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে ফেলি, তা হলে বলতে হবেÑ এটি প্রাথমিকভাবে সামন্তবাদী প্রথার বিরুদ্ধে নিরঙ্কুশ বিজয়। প্রশ্ন আসবেÑ সামন্তবাদ তো পৃথিবীর বুক থেকে বহু আগেই পুঁজিবাদের কাছে পরাজিত হয়ে আছে, তবু সামন্তবাদের কথা আসছে কেন? কিন্তু বাংলাদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে সামন্তবাদী মনোভাবের বিলুপ্তি কখনও হয়নি। সামন্তবাদের মূল কাঠামো হলোÑ পরিবারতন্ত্র, আত্মীয়তন্ত্র ও বৃহত্তর অর্থে গোষ্ঠীতন্ত্র এবং রাজনৈতিক পরিকাঠামোয় সেটি হচ্ছে দলীয়তন্ত্র। অন্য দিকে বুর্জোয়া গণতন্ত্র হলোÑ ব্যক্তিবিশেষের নিজস্ব যোগ্যতার নিরিখে তার অবস্থান নিশ্চিত হওয়া। বাংলাদেশের পঞ্চাশোর্ধ্ব রাজনীতির জগতে দলীয় রাজনীতির নামে প্রকৃত অর্থে সামন্তবাদীর চেতনায় দলীয় রাজনীতির নিকৃষ্টতম চর্চা হয়েছে বলা যায়। আদর্শের চেয়ে ব্যক্তি বড় হয়েছে, দেশপ্রেমের চেয়ে দলীয় প্রেমের আশকারা হয়েছে এবং এই খিচুড়িতন্ত্রের নির্দয়-নিষ্ঠুর প্রকাশ পায় যখন খোলা বুক পাতা সাহসী যুবক-শিক্ষার্থী আবু সাঈদের শরীর পুলিশ গুলিতে ঝাঁজরা করে দেয়।
সাঈদ এখন বিপ্লবের প্রতীকে পরিণত হয়েছে, বিপ্লবটা হয়েছে ব্যক্তিপূজা, দলীয় পূজা, চৌর্যবৃত্তির পূজা, দুর্নীতির পূজা ও সকল রকম বৈষম্যের বিরুদ্ধে; কিন্তু সাঈদসহ অন্যান্য শহীদ ও আহত জনতাকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার জন্য যে অস্বাভাবিক রাজনৈতিক বাতাবরণ তৈরি করা হয়েছিল সেটা কেন হয়েছে সেটি বুঝতে পারাই আমার মনে হয় জেন জেড প্রজন্মের আসল শিক্ষা, যেটির আলোয় দেশ আজ উদ্ভাসিত।
পূর্বতন সরকার কেন মানুষ মারার এরকম নিষ্ঠুর প্রকরণে গেল তার একটি মনস্তাত্ত্বিক কারণ আছে। ১৯৭৫ সালের পট-পরিবর্তনের ফলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন সস্ত্রীক ও সপুত্রক নিষ্ঠুরভাবে মারা গেলেন, তখন তারই কন্যা যখন ক্ষমতায় এলেন, তখন তিনি স্বাভাবিকভাবে জাতির জনকের ও পিতৃমাতৃ হত্যার হোতাদের নেতৃস্থানীয় অনেককেই বিচারের আওতায় এনে আইনের স্বাভাবিক গতিতে তাদের শাস্তিবিধান নিশ্চিত করলেন। এখানেই ব্যাপারটা হয়তো শেষ হয়ে যেতে পারত; কিন্তু ব্যাপারটা এখানে শেষ হয়নি।
মানুষের চরিত্রের নিগূঢ় দিকগুলো নিয়ে জ্ঞানের যে শাখাটি সবচেয়ে বেশি আলোড়িত, সেটি হলো সাহিত্য। সাহিত্যে বহু নিদর্শন আছে কীভাবে একটি রাষ্ট্রীয় এজেন্ডা (যেমন জাতির পিতার হত্যাকারীদের শাস্তি) ক্রমেই প্রতিহিংসায় রূপান্তর হয়ে ব্যক্তিগত ভ্যান্ডেটা বা ব্যক্তিগত প্রতিশোধস্পৃহায় পরিণত হতে পারে।
দ্বিতীয় পর্যায়ে পূর্বতন সরকার প্রথমবার ক্ষমতায় আসে ২০০৮ সালের একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরিচালনায় নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনী ফলাফলের মাধ্যমে। নির্বাচনটি একান্ত সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ছিল বিধায় বিশ্বজনমত স্বীকৃত ছিল। এর পরের নির্বাচনগুলো শাসনতন্ত্র পরিবর্তনের মাধ্যমে দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়। অর্থাৎ ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের কোনও জাতীয় সংসদ নির্বাচন আর গ্রহণযোগ্যতার কাছাকাছি ছিল না। যা-ই হোক, প্রথমবার ক্ষমতায় থেকে পূর্বতন সরকার যুদ্ধাপরাধী ও জাতির পিতার হত্যাকারীদের আইনগত পদ্ধতি অনুসরণ করে শাস্তির বিধান নিশ্চিত করে; কিন্তু এর পর থেকে সরকারের কেন্দ্রীয় কক্ষপুটে প্রতিহিংসার চারিত্র ঢোকে এবং প্রতিহিংসার অতৃপ্তি কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব থেকে নিচের দিকের র্যাংক অ্যান্ড ফাইলে উপচে পড়ে। মনস্তত্ত্ববিদ্যা বলছেÑ কোনও লোক প্রতিহিংসাপরায়ণ হলে তখন সে সর্বত্র প্রতিহিংসার উপকরণ খুঁজে পায় এবং সে লোক যদি ক্ষমতাধর হয়ে থাকে তা হলে সেটি জাতির জন্য বিপদ ডেকে আনে। তখন তার মনে হয় যে, প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে হলে ক্ষমতায় থাকা দরকার। আর ক্ষমতা মানে একটি অসৎ দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক সমাজে হলোÑ বিপুল নিষ্ঠুরতা প্রদর্শনের ক্ষমতা আর সঙ্গে থাকছে অবৈধ সম্পদ ও অর্থের অধিকারী হওয়া।
ক্ষমতা ধরে রাখার এই প্রলম্বিত উৎসবে জাতির অর্থনীতি, প্রশাসন, শিক্ষা, ব্যবসা, সংস্কৃতি নিরঙ্কুশভাবে ঠকেছে। বলা যাবে না যে, আইন শৃঙ্খলাবাহিনীও ঠকেনি। ব্যক্তিগতভাবে আমার সরাসরি ছাত্র-ছাত্রী পুলিশের বড় বড় জায়গায় অধিষ্ঠিত ছিল বা আছে, যারা সৎ ও দক্ষ অফিসার হিসেবে সুপরিচিত ছিল বা আছে; তারাও আজকে বিব্রতকর পরিস্থিতির শিকার।
জুলাই-আগস্ট মাসে ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে প্রতিহত করার জন্য প্রকৃতপক্ষে যেটি হয়েছে সেটি হচ্ছে একজনের বা একটি পরিবারের প্রতিহিংসাপরায়ণতাকে জাতীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে (যেমনÑ পুলিশ, প্রশাসন, বিশ্ববিদ্যালয়) একটি সর্বজনীন রূপ দেওয়ার চেষ্টা করা। সে চেষ্টার মধ্যে যে বুজরুকি ছিল, একটি ম্যাকিয়াভেলিয়ান শঠতা ছিল সেটিই ধরা পড়ে ‘জেন জেড’ নামি প্রজন্মের যুবসমাজের কাছে। শুধু কি তাই? পূর্বতন সরকারি দলের কাছেও কি ধরা পড়েনি এই নিষ্ঠুর অবাস্তব চালগুলোর কথা। ওই সংকটময় সময়ে বহু সরকারদলীয় ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীর সঙ্গে আলাপে আলাপে জানতে পারতাম যে, তারাও নানান অনিশ্চয়তায় ভুগছেন কেন্দ্র থেকে জারি করা সিদ্ধান্তগুলো নিয়ে। এখানে আমার মনে হয় আরও একটি ব্যাপার ঘটে গেছেÑ পূর্বতন সরকারি দলটির যে দীর্ঘ ঐতিহ্য গণতান্ত্রিক আন্দোলনে স্বীকৃত ছিল, সেই ঐতিহ্যেরই স্থায়ী ক্ষতি করে গেছে পূর্বতন সরকারের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের দায়িত্বপালনের শেষ কয়েক সপ্তাহের সিদ্ধান্তগুলো। দল যেখানে থাকার কথা সেখানেই ছিল, তিনিই বেরিয়ে এসেছিলেন দল থেকে ওই ব্যক্তিগত প্রতিহিংসাপরায়ণতার জন্য।
তা হলে মুগ্ধের ভাই স্নিগ্ধরা যখন আবার শিক্ষালয়ে ফিরে যাবে তখন তারা যেটি শিখেছে সেটির যাতে প্রয়োগ হয়, তা-ই দেখবে। তারা দেখবে যে, বৈষম্যবিরোধী শিক্ষা লাভ তখনই সম্ভব, যখন মেধানির্ভর যুক্তির বিকাশ হয়। যখন শিক্ষার্থী অসম, অসহ আস্ফালনমূলক শিক্ষা গ্রহণ না করে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বিজ্ঞানভিত্তিক বাস্তব জগৎটাকে দেখতে পারে। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সেই শিক্ষা, যেটি শেখায়Ñ যেটি অন্যায়, অন্যায্য, অযৌক্তিক ও অসৎ তার চোখে চোখ রেখে আবু সাঈদ হওয়া। শিক্ষার চরিত্র হতে হবে মানুষের প্রতি অনুকম্পা শিখতে পারা, যা কবিগুরুর ভাষায়Ñ ‘তব দয়া দিয়ে হবে গো মোর জীবন ধুতে।’
লেখক : শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক