বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের মধ্যে জুলাইয়ের অভ্যুত্থানের পর যেভাবে একের পর এক উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে, তার প্রভাব এখন সুনির্দিষ্টভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যেও দেখা যাচ্ছে। ভারত বাংলাদেশের জন্য যে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা প্রদান করছিল, তা স্থগিত করেছে। এদিকে, বাংলাদেশও স্থলপথে ভারতের সাথে সুতা আমদানি বন্ধ করে দিয়েছে। এসব সমস্যা নিয়ে যখন দেশীয় ব্যবসায়ী এবং উদ্যোক্তাদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে, তখন ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধের উত্তেজনা দক্ষিণ এশিয়ায় আরও অস্থিরতা তৈরি করেছে। ব্যবসায়ী নেতারা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন যে, যদি এ যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হয়, শুধু দক্ষিণ এশিয়াতে নয়, সারা বিশ্বে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য হুমকির মুখে পড়বে। বিশেষত, তৈরি পোশাক রপ্তানির খাত, যা দেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান উৎস, তা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। এ খাতের প্রধান কাঁচামাল, তুলা, ভারতের কাছ থেকে আমদানি করা হয়, এবং এই তুলা আমদানি যদি সমস্যায় পড়ে, তাহলে ইউরোপ এবং আমেরিকায় ক্রয়াদেশ পাঠাতে বিলম্ব হতে পারে। এ বিষয়ে বিকেএমইএর প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ হাতেম বলেছেন, ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের পর এখন ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ শুরু হওয়ায় রপ্তানি খাতে বড় ধরনের প্রভাব পড়তে পারে। তিনি জানিয়েছেন, সীমান্ত বাণিজ্য ইতোমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং যুদ্ধের কারণে সীমান্তে কড়াকড়ি, স্থল ও আকাশপথে সতর্কতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে বাণিজ্য আরও কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আকাশপথ বন্ধ হলে, বিকল্প পথ দিয়ে পণ্য পরিবহন করতে খরচ বাড়বে, যা ব্যবসায়ীদের জন্য অপ্রত্যাশিত চাপ তৈরি করবে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) পরিসংখ্যানের আলোকে জানা যায়, দক্ষিণ এশিয়াতে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি গন্তব্য ভারত এবং পাকিস্তান। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ ভারতে ১ হাজার ৫৭০ মিলিয়ন ডলার এবং পাকিস্তানে ৬২ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। ভারতীয় বাণিজ্য বিভাগের পরিসংখ্যান অনুসারে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে বাংলাদেশ ২০৩ কোটি ডলারের তুলা আমদানি করেছে, যার পুরোটাই ব্যবহৃত হয়েছে তৈরি পোশাক খাতে। এ ধরনের পরিসংখ্যানের মাধ্যমে দৃশ্যমান হচ্ছে যে, ভারতের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের জন্য বড় বিপদ আসতে পারে। বিজিএমইএর সাবেক প্রেসিডেন্ট আনোয়ার উল-আলম চৌধুরী (পারভেজ) বলছেন, ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলে প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ, বাংলাদেশ যেসব পণ্য আমদানি ও রপ্তানি করে, তার মধ্যে ভারত ও পাকিস্তান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তৈরি পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তারা একমত, বাংলাদেশে গার্মেন্ট শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ভারতীয় পণ্যের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে তুলা। মোট আমদানি খরচের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এই কাঁচামাল আমদানিতে ব্যয় হয়। ফলে, ভারত থেকে আমদানি করা পণ্য দেশের রপ্তানির কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহার হচ্ছে। যদি এই আমদানি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তবে দেশের পুরো রপ্তানি খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, বিশেষ করে ইউরোপ এবং আমেরিকার ক্রয়াদেশে বিলম্ব হতে পারে। ফজলুল হক, বিকেএমইএর সাবেক প্রেসিডেন্ট, জানিয়েছেন, যদি ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হয়, তবে শুধু দক্ষিণ এশিয়ায় নয়, সারা বিশ্বেই বাংলাদেশের রপ্তানির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কারণ, এ দুটি দেশ থেকে আমদানিকৃত তুলা ও সুতা দিয়ে তৈরি পোশাক পশ্চিমা দেশগুলোতে রপ্তানি করা হয়। বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, বিশেষ করে তৈরি পোশাক শিল্পের ভবিষ্যৎ এখন যুদ্ধের মেঘের মতোই অস্থির। পরিস্থিতি না শুধুমাত্র দেশের, বরং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্যও একটি বড় সংকট তৈরি করতে পারে।