বাংলাদেশের বস্ত্র খাত বর্তমানে এক কঠিন সংকটের মুখোমুখি। গ্যাস ও বিদ্যুতের বাড়তি খরচ, সুতার লাগামহীন দাম, আমদানিনির্ভরতা, নীতি সহায়তার অভাব, প্রণোদনা কমানো এবং মূল্য সংযোজনের অভাবে রপ্তানিমুখী এই খাত লোকসানের বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় একটি বস্ত্র কারখানা ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে, যার ফলে ১২ হাজার কর্মী চাকরি হারিয়েছেন এবং বিনিয়োগ ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৩,৭০০ কোটি টাকার।
খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, ভারত ও চীনের তুলনায় বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা কম ভর্তুকি ও ব্যবসাবান্ধব নীতিগত সহায়তা পাচ্ছেন। স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণের প্রক্রিয়ায় প্রণোদনা কমানোর ফলে রপ্তানিতে চাপ তৈরি হয়েছে, যা পোশাকের মূল্য সংযোজন কমাচ্ছে। বিটিএমইএর তথ্য অনুযায়ী, পোশাক খাতে বছরে ৪৭৮ কোটি ডলার প্রয়োজন, যার মধ্যে ২০২৪ সালে সুতা আমদানি হয়েছে ২২৮ কোটি ডলারের।
এক উদ্যোক্তা জানান, জ্বালানিসংকট এবং আমদানি বাড়ানোর কারণে ১০ লাখ কেজির সুতা তৈরির সক্ষমতাসম্পন্ন একটি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। বিটিএমএ পরিচালক মো. খোরশেদ আলম বলেন, “গত আট মাসে ২৬ হাজার শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন এবং দক্ষিণ এশিয়ার বড় স্পিনিং কারখানাগুলোর মধ্যে একটি বন্ধ হয়ে গেছে।”
বিটিএমএ সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, “বাংলাদেশের প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে, কারণ ভিয়েতনাম, ভারত ও চীনের মতো দেশগুলো সরকারি প্রণোদনা পাচ্ছে।” তিনি আরও বলেন, “দেশের সুতা উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও সরকারের ভ্রান্ত নীতির কারণে ভারত থেকে সুতা আমদানি করতে হয়।”
নিট পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন-বিকেএমইএ জ্যেষ্ঠ সভাপতি ফজলে শামীম এহসান জানান, “আমার কারখানা গত ২০ বছরে কোনো সুতা আমদানি না করলেও গত সাত-আট মাস স্থানীয় বাজার থেকে কোনো সুতা কিনিনি।” তিনি বলেন, “সরকার প্রণোদনা কমিয়ে দেওয়ার ফলে উদ্যোক্তাদের কম দামে সুতা আমদানি করতে হচ্ছে।”
এদিকে, দেশের পোশাকশিল্পের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও মোড়ক পণ্যের শিল্পে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে। বিজিএপিএমইএর সভাপতি মো. শাহরিয়ার বলেন, “২০২৪-২৫ অর্থবছরে এই খাতের সরাসরি রপ্তানি আয় ১৬০ কোটি ডলার, যা আগের অর্থবছরে ছিল ১৪৯ কোটি ডলার।”
উর্মি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসিফ আশরাফ বলেন, “সংকট থেকে উত্তোরণে উৎপাদন খরচ কমাতে হবে। বিদ্যুৎ-জ্বালানি সমস্যার সমাধান জরুরি।” তিনি সরকারের নীতি সহায়তার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন, বিশেষ করে ভারত ও চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে মূল্য সংযোজন ও ভ্যালু চেইনে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
সার্বিকভাবে, বাংলাদেশের বস্ত্র খাতের সংকট গভীর হচ্ছে, এবং উদ্যোক্তাদের উদ্বেগ বাড়ছে। সরকারের নীতি সহায়তা ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করা হলে এই খাতের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে পড়তে পারে।