ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের গণহত্যা অব্যাহত রয়েছে। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, এই গণহত্যা থামানোর কেউ নেই। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর তথ্য অনুযায়ী, গাজা এলাকায় হামলা শুরুর পর থেকে গত ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৪২ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে ইসরায়েলের বর্বর বাহিনী। বলা বাহুল্য নিহতদের অধিকাংশই নারী, শিশু ও নিরস্ত্র মানুষ। এভাবে যে একটি দেশের ওপর হামলা চালিয়ে হাজার হাজার নিরস্ত্র মানুষকে অবলীলায় হত্যা করা যায়, গোটা বিশ^কে সেটা দেখিয়ে দিচ্ছে ইসরায়েল। তার টিকিটিও কেউ ছুঁতে পারছে না। আরব-অনারব দেশগুলো মুখেই কুঁই-কুঁই করছে শুধু। জাতিসংঘও অসহায় চোখে দেখছে আর মাঝে মাঝে বিবৃতি দিচ্ছে, হিসাব দেখাচ্ছে তাদের কতজন কর্মীকে হত্যা করল আর তাদের কতগুলো স্থাপনা ধ্বংস করল হানাদার ইসরায়েলিরা। ২০২৪ সালে এটা যদি পৃথিবীর বিস্ময়কর ঘটনা না হয়, তাহলে বিস্ময়কর ঘটনা কী! বেনজামিন নেতানিয়াহুর মতো একজন হত্যাকারী নির্বিঘ্নে ও প্রকাশ্যে মানুষ হত্যা করে চলেছে, তাকে থামানোর কেউ নেই!
ইসরায়েলি গণহত্যা থেকে রেহাই পাচ্ছেন না সংবাদকর্মীরাও। সংবাদমাধ্যমের কার্যালয় পর্যন্ত ধুলিসাৎ করে দিয়েছে হানাদাররা। গত ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গাজায় নিহত হয়েছেন ১১৬ জন সাংবাদিক ও সংবাদকর্মী (তাদের মধ্যে ফিলিস্তিনি সাংবাদিকের সংখ্যা ১১২), আহত হয়েছেন ৩৫ জন, নিখোঁজ ২ জন এবং ইসরায়েলের হাতে আটক হয়েছেন ৫৪ জন। এ তথ্য জানিয়েছে আন্তর্জাতিক সংগঠন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে)। ৪২০০০ এবং ১১৬Ñ এগুলো কি শুধু সংখ্যা? বিশে^র শক্তিধর দেশগুলোর মতিগতি দেখে তো মনে হয় না, এগুলোকে তারা সংখ্যার চেয়ে বেশি কিছু মনে করে। নইলে এত শিশু এত নারী এত নিরস্ত্র মানুষকে মারা হচ্ছে, কারও কোনো বিকার নেই কেন! অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপের দেশগুলো, যুক্তরাষ্ট্র প্রত্যেকে যে মানবাধিকারের কথা বলে, গণতন্ত্রের কথা বলে- তা কি শুধুই ভড়ং? নেতানিয়াহুর সাইকোপ্যাথিক হত্যাকাণ্ড বন্ধের কার্যকর উদ্যোগ নিতে পারত এসব দেশ। নেয়নি। বরং ইসরায়েলকে অস্ত্রের জোগান দিচ্ছে, টাকা-পয়সা দিচ্ছে। এমনকি ভারতসহ তৃতীয় দুনিয়ার কিছু দেশও অস্ত্র দিচ্ছে ইসরায়েলকে। এর অর্থ কী?
এইসব অস্ত্রেই হত্যা করা হচ্ছে সাধারণ ফিলিস্তিনিদের এবং সাংবাদিকদের। ইসরায়েলি ঘাতকবাহিনীর হামলায় ঘর-বাড়ি হারিয়ে আশ্রয় শিবিরে আশ্রয় নিয়েও বাঁচতে পারছে না ফিলিস্তিনিরা, সেখানেও হামলা চালাচ্ছে ঘাতকরা। একের পর এক ঘটে চলেছে এসব ঘটনা- একদিকে যা পৈশাচিক, আরেক দিকে মর্মন্তুদ। মানবতার বিশ^ভাবনা বলে কিছুই যে আর অবশিষ্ট নেই, এসব কি তারই দৃষ্টান্ত? ইসরায়েলের গাজা আক্রমণের পর থেকে নিহত সাংবাদিকদের পূর্ণ তালিকা ও ডেটাবেজ প্রকাশ করেছে সিপিজে। ওই তালিকায় অন্তত পাঁচজন সাংবাদিকের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, ইসরায়েলি ঘাতকবাহিনী যাদের সরাসরি টার্গেট করে হত্যা করেছে বলে জানিয়েছে সিপিজে। ওই পাঁচজন ফিলিস্তিনি সাংবাদিক হলেন- ইসাম আবদাল্লাহ, হামজা আল দাহ্দুহ্, মুস্তাফা তুরাইয়া, ইসমাইল আল গুল ও রামি আল রেফি। এছাড়া আরও অন্তত ১০ জন সাংবাদিককে টার্গেট করে হত্যা করেছে ইসরায়েলি ঘাতকবাহিনী- এমন তথ্যও রয়েছে সিপিজের হাতে। তারা এ ধরনের অন্য ঘটনাগুলোর তদন্ত করছে। নতুন নতুন তথ্য আসছে। সেসব থেকে ফুটে উঠছে ভয়াবহ রকমের মানবতাবিরোধী অপরাধের চিত্র।
ফিলিস্তিন দখল করে নেওয়ার পর থেকেই মানবতাবিরোধী অপরাধ করে চলেছে ইসরায়েলি জায়নবাদীরা। তারা ফিলিস্তিনিদের ঘরবাড়ি ধ্বংস করেছে, ফিলিস্তিনিদের জমিজমা ও পানির উৎসগুলো দখল করেছে, ফিলিস্তিনি নারী-পুরুষ-শিশুদের হত্যা করেছে এবং জীবিতদের বিতাড়িত করেছেÑ এটি সাধারণ ধারণা। আসল বিষয়টা হলো, ফিলিস্তিন ভূখণ্ড দখল করার আগে থেকেই ইসরায়েলি জায়নবাদীরা মানবতাবিরোধী অপরাধ করে চলেছে। ইতিহাস তার সাক্ষী হয়ে রয়েছে।
কিন্তু কখন একটি গোষ্ঠী এমন কালান্তক যমের মতো রক্তলোলুপ হয়ে ওঠে? উত্তর হচ্ছে- যখন সে পৃষ্ঠপোষকতা পায়। ইসরায়েলি জায়নবাদ হচ্ছে এ যুগের উপনিবেশবাদ। ইহুদি ধর্মের একটা মোড়ক লাগিয়ে ইউরোপীয় উপনিবেশবাদীরা তৈরি করেছে জায়নবাদ, সেটার রূপায়ন ঘটিয়েছে ফিলিস্তিনে। এটা ভয়ঙ্কর বর্ণবাদও বটে। ইসরায়েলের এবং দুনিয়ার অন্যান্য স্থানের কট্টর ইহুদিবাদীরা নিজেদের ছাড়া মানবজাতির আর সবাইকে ‘সাব-হিউম্যান’ বলে বিশ^াস করে, বিশেষ করে ফিলিস্তিনিদের। এটাকে শুধু বর্ণবাদ বললে কিছুই বলা হয় না, এই চিন্তা ও বিশ^াস গোটা মানবজাতির জন্য ভয়ঙ্কর অভিশাপ।
অভিশপ্ত পিশাচ এই জায়নবাদীদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে চলেছে সভ্যতা আর মানবতার উকিল পশ্চিমা বিশ^। তারা মদদ দেয়, জায়নবাদী ইসরায়েল হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে। এটাই ঘটে চলেছে কয়েক দশক ধরে। পশ্চিমা বিশ^ তারপরও বলে, ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার আছে! এ কথার অর্থ আজ এটাই করতে হবে যে, ইসরায়েলের ফিলিস্তিনি হত্যার অধিকার আছে। কেননা ইসরায়েল যেটাকে আত্মরক্ষা বলে চালিয়ে আসছে এ যাবৎ, তা আসলে হত্যাযজ্ঞ। বর্তমান সময়ে এসে দেখা যাচ্ছে, ইসরায়েলের মানবতাবিরোধী অপরাধের অতীত চিত্র বদলায়নি একটুও; বরং বেড়েছে আকারে ও আয়তনে। সাংবাদিকদের টার্গেট করে হত্যা করা তারই দৃষ্টান্ত বহন করছে। কেন তারা সাংবাদিকদের হত্যা করছে, এ প্রশ্নের উত্তর স্পষ্টÑ জায়নবাদী নয়া ঔপনিবেশিকরা অধিকাংশ ফিলিস্তিনিকে হত্যা ও বিতাড়িত করেছে; বেঁচেবর্তে থাকা অবশিষ্ট যারা ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকা ও পশ্চিম তীরে মানবেতরভাবে বসবাস করছে, তাদের নিশ্চিহ্ন করে ও হটিয়ে দিয়ে সম্পূর্ণ ফিলিস্তিন দখলের পরিকল্পনা রূপায়ন করা। এই লক্ষ্য নিয়ে আগ্রাসন চালাচ্ছে ইসরায়েল। সাংবাদিকরা এসব তথ্য বিশে^র সামনে তুলে ধরছেন, ইসরায়েলি জায়নবাদী হানাদারদের মানবতাবিরোধী অপরাধ সম্পর্কে সংবাদচিত্র বিশ^বাসী জানতে পারছে। গাজায় বেশকিছু গণকবরের সন্ধান দিয়েছেন সাংবাদিকরা। সুতরাং ইসরায়েলের ঘাতকবাহিনী তাদের টার্গেট করছে।
এভাবেই কি চলতে থাকবে? অন্যায়ের কাছে কি ন্যায় পরাজিত হবে? ফিলিস্তিনিদের পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে জায়নবাদীরা? ফিলিস্তিনি শিশুরাও কি বাঁচার অধিকার রাখে না? অনেক প্রশ্ন। অনেক দিনের প্রশ্ন। অনেক দিন থেকে এসব প্রশ্ন কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে বিশ^ মানবসমাজের বিবেকবান অংশের সামনে। উত্তর? জানা-অজানার ভিড়ে হারিয়ে গেছে উত্তর।
প্রমিত হোসেন : সাহিত্যিক। ফিকশন, নন-ফিকশন বইয়ের অনুবাদক