গত ৩৬ জুলাই সংঘটিত ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী আওয়ামী সরকারের পতন ঘটেছে শেখ হাসিনার ভারতে পলায়নের মধ্য দিয়ে। ৩৬ জুলাই লেখার কারণ, অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দানকারী ছাত্ররা ৫ আগস্টকে ‘৩৬ জুলাই’ বলে অভিহিত করছে। পরপর তিনবার জাল-জালিয়াতির নির্বাচন করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার পর শেখ হাসিনার ধারণা জন্মেছিল যে, তিনি আমৃত্যু ক্ষমতায় থাকতে পারবেন। কিন্তু তার তাকদিরে লেখা ছিল জিল্লতি যা তাকে সম্ভবত মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বহন করতে হবে।
এখন কথা উঠেছে, প্রচলিত সংবিধানে একজন প্রধানমন্ত্রী কী করে স্বৈরাচারী হয়ে উঠলেন? আসলে আমাদের সংবিধানেই একজন নেতা বা নেত্রীর স্বৈরাচারী হয়ে ওঠার সুযোগ রয়েছে। আমাদের প্রচলিত নির্বাচন ব্যবস্থায় প্রার্থীদের মধ্যে যিনি সর্বোচ্চ ভোট পান তাকেই বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। এটিকে বলা হয়, ‘First past the post system. এতে অনেকসময় একটি আসনে ৩০ শতাংশ বা তার কম ভোট পেয়েও একজন প্রার্থী নির্বাচিত হতে পারেন। অথচ উল্টোভাবে চিন্তা করলে দেখা যায়, তিনি ওই এলাকার ৭০ শতাংশ মানুষের পছন্দের প্রার্থী নন। অর্থাৎ তিনি ওই এলাকার সংখ্যালঘু মানুষের ভোট পেয়ে পুরো এলাকার জনপ্রতিনিধিত্ব করছেন। একইভাবে একটি দলও ৩০ শতাংশ বা তার কিছু বেশি ভোট পেয়ে সরকার গঠন করে ফেলতে পারে। এমনকি ৫০ শতাংশ বা কমবেশি ভোটে তিন-চতুর্থাংশ আসন পেয়ে নিজের মতো করে সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা হাতে পেয়ে যেতে পারে।
বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনগুলোর ফলাফলের দিকে তাকালে ব্যাপারটি স্পষ্ট হবে। ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৪৮ শতাংশের মতো ভোট পেয়ে ২৩০টি আসন লাভ করে। পক্ষান্তরে বিএনপি ৩৩ শতাংশের মতো ভোট পেয়ে লাভ করে ৩০টি আসন। যার ফলে আওয়ামী লীগ কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা বাতিল করতে সক্ষম হয়। যদি আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচনী ব্যবস্থা থাকত তাহলে আওয়ামী লীগ পেত ১৪৪টি এবং বিএনপি পেত ৯৯টি আসন। এরকম পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ কখনোই কেয়ারটেকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত করতে পারত না। আবার ২০০১ সালে অনুষ্ঠিত অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ৪১ শতাংশের মতো ভোট পেয়ে আসন পেল ১৯৩টি। আর আওয়ামী লীগ ৪০ শতাংশের মতো ভোট পেয়ে আসন পেল ৬২টি। এ কারণে অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন, আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচন ব্যবস্থা চালু করা হলে কোনো দলের পক্ষে স্বৈরাচারী হওয়া অসম্ভব হবে। বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এমন কোনো রাজনৈতিক দল নেই যারা ৬৬ শতাংশ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়ে সংবিধান সংশোধন করা মতো ক্ষমতা পেতে পারে।
এ ছাড়া আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচন-ব্যবস্থার আরো কিছু ইতিবাচক দিক রয়েছে। যেমন- এই নির্বাচন ব্যবস্থায় যদি পার্টি লিস্ট অর্থাৎ দলীয় তালিকার ভিত্তিতে করা হয় তা হলে পেশিশক্তির ব্যবহার যেমন কমে যাবে, তেমনি টাকার খেলাও কমে যাবে। রাজনৈতিক নেতারা নিজের বিজয় নিশ্চিত করার জন্য পেশি ও অর্থের ব্যবহার যেভাবে করে থাকেন দলের বিজয়ের জন্য তা করতে আগ্রহী হবেন না। কারণ দল জিতলেও তিনি না-ও জিততে পারেন। আর দলগুলোও তখন তাদের প্রার্থী তালিকায় ভালো লোকদের, অর্থাৎ শিক্ষিত, জ্ঞানী-গুণী, মার্জিত, ভদ্র, পরিচ্ছন্ন ইমেজের প্রার্থী রাখবে।
অনেকেই বলেন, বর্তমান নির্বাচন-ব্যবস্থায় ভালো মানুষের অংশগ্রহণ সম্ভব নয়। কারণ তাদের না আছে পেশিশক্তি, না আছে টাকার জোর। আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচন-ব্যবস্থা সেই অবস্থা থেকে দেশকে উদ্ধার করে একটি পরিচ্ছন্ন রাজনৈতিক ব্যবস্থার দিকে নিয়ে যেতে পারে।
কিছু ছোট রাজনৈতিক দল আছে যাদের শীর্ষ নেতারা জ্ঞান-গরিমা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার দিক থেকে বড় দলগুলোর চেয়ে পিছিয়ে নেই। কিন্তু পেশি ও অর্থবিত্তের দাপটের কারণে তারা নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে পারেন না। আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচন তাদের জন্য নির্বাচনে জয়লাভের সুযোগ সৃষ্টি করে দেবে। কোনো দল যদি ১ শতাংশ ভোট পায় তাহলে তারা তিনটি আসন লাভের যোগ্য হবে। আর যদি ২ শতাংশ ভোট পায় তাহলে ছয়টি আসনের ভাগীদার হবে।
আরেকটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন, তা হচ্ছে- এই নির্বাচন-ব্যবস্থা দেশকে হানাহানির রাজনীতি থেকে মুক্তি দিয়ে সমঝোতার রাজনীতির পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে। কারণ কোনো দল যদি ৫০ শতাংশের কম ভোট পায় তাহলে সেই দল এককভাবে সরকার গঠন করতে পারবে না। তাকে অন্য দলের সাথে সমঝোতায় যেতে হবে। এরকম একটি পরিস্থিতি যখন তৈরি হবে তখন সব দলই হানাহানি-নির্মূলের রাজনীতি বাদ দিয়ে সমঝোতা, সহাবস্থানের রাজনীতির দিকে ধাবিত হতে বাধ্য হবে।