টানা সাড়ে ১৫ বছর কর্তৃত্ববাদী হাসিনা সরকারের দমনপীড়নে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি বিএনপি। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরও দলটির নেতাকর্মীর ফাঁড়া কাটছে না। শেখ হাসিনা ক্ষমতা হারানোয় বিএনপি নেতাকর্মীর মনে স্বস্তি ফিরলেও পিছু ছাড়ছে না মামলা।
পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর গুলি এবং নির্যাতনে গণহত্যার বিরুদ্ধে সারাদেশে করা মামলায় বিএনপির অনেক নেতাকর্মীকে আসামি করে ফাঁসিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটছে। এর নেপথ্যে রয়েছে দলটির ঘরোয়া বিবাদ ও নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা। এক পক্ষ আরেক পক্ষকে ঘায়েল করতে মামলাকে ‘অস্ত্র’ হিসেবে ব্যবহার করছে। আবার নিজ নিজ এলাকায় আধিপত্য জারি রাখতে কৌশলে ঠুকে দেওয়া হচ্ছে মামলা। কিছু মামলায় নিরীহ ও সাধারণ মানুষের নামও ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
তবে বিএনপি নেতারা মনে করছেন, এ রকম ঘটনা গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ। পুরো মামলা প্রক্রিয়াকে বিতর্কিত করতে এ কাণ্ড ঘটানো হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আঁতাতের অভিযোগেরও প্রমাণ মিলছে।
গেল ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সারাদেশে ওই দলটির নেতাকর্মী ছাড়াও তাদের দোসর হিসেবে প্রশাসনের চিহ্নিতদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা হচ্ছে। এ রকম অন্তত পাঁচটি মামলা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সেখানে আসামির তালিকায় ওপরে শেখ হাসিনাসহ ওই দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের নাম রেখে সুকৌশলে বিএনপি নেতাকর্মীর নামও জুড়ে দেওয়া হয়েছে। যারা বিগত দিনে আন্দোলন-সংগ্রামে রাজপথে ছিলেন, সক্রিয় রাজনীতিতে আছেন– এমন নেতার নাম দেখে বিস্মিত দলটির নেতাকর্মীরা।
তারা অভিযোগ করেন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিএনপির কতিপয় নেতা আওয়ামী লীগের স্থানীয় বিত্তশালী নেতার সঙ্গে যোগসাজশে তাদের নাম মামলা থেকে বাদ দিচ্ছেন। টাকার বিনিময়ে তাদের অপকর্ম দেওয়া হচ্ছে ছাইচাপা। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ নেতারা বাদীকে নানাভাবে প্রভাবিত করে পছন্দমতো মামলায় আসামি হিসেবে ঢুকিয়ে দিচ্ছেন।
বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী সমকালকে বলেন, ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন ঘটলেও তাদের প্রেতাত্মারা এখনও রয়ে গেছে। তারা বিভিন্ন ষড়যন্ত্র করছে। তবে এসব করে লাভ হবে না। পাপের শাস্তি পেতেই হবে। তারা সব মামলা পর্যবেক্ষণ করছেন। যেখানে যে ত্রুটি রয়েছে, তা দূর করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীরা বলছেন, আওয়ামী লীগ আমলে এ মামলা-হামলায় তারা বছরের পর বছর ঘরছাড়া ছিলেন। যখন সেই সরকারের পতন ঘটেছে, একটি স্বস্তি ফিরেছে, তখনই কোনো কোনো মামলায় বিএনপি নেতাকর্মীকে আসামি করা হচ্ছে। এতে একদিকে মামলার ভিত্তি যেমন দুর্বল হচ্ছে, তেমনি ক্ষতি হচ্ছে পুরো দলের। আবার কিছু জায়গায় মামলা নিয়ে চলছে কাদা ছোড়াছুড়ি। কার নেতৃত্বে কত মামলা হচ্ছে, সেটার দিকে নজর দিচ্ছেন সিন্ডিকেট নেতারা। ফলে মামলার গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো এড়িয়ে তড়িঘড়ি করে দায়সারা মামলা হচ্ছে বলে আইনজীবীরা জানান।
বিএনপি নেতারা আসামি হয়েছেন– এমন মামলার মধ্যে ২২ আগস্ট সিএমএম আদালতে আদাবর থানা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক রবিউল খান হিল্লোল একটি হত্যার ঘটনায় শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান খান কামাল, জাহাঙ্গীর কবির নানকসহ ৬৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলাটি মোহাম্মদপুর থানাকে গ্রহণ ও তদন্তের জন্য নির্দেশনা দেন আদালত। এ মামলার ৪৮ নম্বর আসামি শফিকুল ইসলাম সনেটের পিতা হাজি সাইদুল ইসলাম ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাবেক সভাপতি। সনেট বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ১০টির বেশি রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলার আসামি। একই মামলায় ৪৮ নম্বর আসামি আমজাদ হোসেন সরকারি কমার্শিয়াল কলেজ ছাত্রসংসদের ভিপি ছিলেন। তিনি ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির দপ্তর সম্পাদক। ওই মামলায় ৬৪ নম্বর আসামি মোহাম্মদ রতন বিএনপির সক্রিয় কর্মী।
ঘটনার বিষয়ে স্থানীয় নেতাকর্মীরা জানান, মূলত স্থানীয় কাটাসুর বাজারের নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে বিএনপির ওই তিনজনকে আসামি করা হয়েছে। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর এ বাজার প্রতিষ্ঠা করেন তৎকালীন বিএনপি নেতা হাজি সাইদুল। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সেটার নিয়ন্ত্রণ নেন ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর তারিকুজ্জামান রাজীব। তাঁর হয়ে বাজারের চাঁদা আদায় করতেন মিন্টু নামে আওয়ামী লীগের এক নেতা। ওই মিন্টুর ছোট ভাই স্থানীয় যুবদল নেতা অ্যাডভোকেট সেন্টু আলম খান এ মামলার আইনজীবী।
যদিও মামলার বাদী রবিউল খান হিল্লোল বলেন, তিনি যে মামলা করেছেন, সেখানে সবাই আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী। বিএনপির নেতাকর্মী নামে যাদের কথা বলা হচ্ছে, তারাও আওয়ামী লীগ করতেন।
মোহাম্মদপুর থানার এক মামলার আসামি ফয়সাল আহমেদ বাবু ওরফে ঘাট বাবু। তিনি মোহাম্মদপুর থানা ছাত্রদলের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক এবং মোহাম্মদপুর থানা বিএনপির সাবেক সহস্বনির্ভরবিষয়ক সম্পাদক। ওই মামলার বাদী রফিকুল ইসলাম একজন হকার। তিনি কোনো রাজনীতি করেন না বলে দাবি করেছেন। ফয়সাল আহমেদ বাবুকে আসামি করার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, তিনি বাবুকে চেনেন না। স্থানীয় বিএনপি-জামায়াত ও থানা পুলিশ হয়তো এ নাম দিয়েছে।
বিএনপি নেতাকর্মীরা জানান, মূলত মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ এলাকায় পরিবহন ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতে আগে থেকেই বাবুকে কোণঠাসা করতে এ মামলায় তাঁর নাম দেওয়া হয়েছে।
রাজধানীর উত্তরা পূর্ব থানায় ২৩ আগস্ট শেখ হাসিনাকে প্রধান আসামি করে করা মামলায় ১৮৪ নম্বর আসামি করা হয়েছে রুবেল মিয়া নামে একজনকে। তিনি ঢাকা হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সিঅ্যান্ডএফ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। কোনো রাজনীতির সঙ্গে না থাকলেও বিমানবন্দরে এ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্যই তাঁকে আসামি করা হয়। মামলার বাদী সালমা বেগম নিজেও এই রুবেল মিয়াকে চেনেন না বলে জানান।
বিএনপি নেতাকর্মীরা জানান, ঢাকা বিমানবন্দর থানা আওয়ামী লীগ নেতা ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট শাজাহান এখন ভোল পাল্টে বিএনপি নেতাদের সঙ্গে টাকার বিনিময়ে সখ্য গড়ে তাঁর প্রতিপক্ষকে মামলা দিয়ে হয়রানি করছেন। রুবেলের মতো বিমানবন্দরের বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
একইভাবে বাড্ডা থানার এক মামলায় ৪৫ নম্বর আসামি করা হয়েছে ইসমাইল হোসেন সিরাজীকে। পৈতৃকভাবে বাড্ডা এলাকায় সিরাজীর অনেক জমির মালিকানা থাকায় তাঁকে উচ্ছেদের জন্য হত্যা মামলায় জড়ানো হয়েছে বলে জানান তিনি।
ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সদস্য সচিব আমিনুল হক বলেন, সবকিছু দেখে মনে হচ্ছে, তড়িঘড়ি করে মামলা করা হচ্ছে। আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার কিংবা তাদের স্বজন এসব মামলা করছেন। অনেক সময় তারা নিজেরা কারও সঙ্গে আলাপ না করে মামলা করায় নানা ভুলভ্রান্তি থাকছে। বিএনপির নেতারা সম্পৃক্ত থাকলে এ ধরনের ভুল হওয়ার কথা নয়।
মামলায় বিএনপি নেতাকর্মীকে ফাঁসানোর পাশাপাশি মামলা নিয়ে নিজেদের প্রভাব বিস্তারের ঘটনাও রয়েছে। গত ১৯ জুলাই সারাদেশে ছাত্রহত্যার প্রতিবাদে বিএনপি ঘোষিত সমাবেশে বাধা দেওয়ার প্রতিবাদে দলটির নেতাকর্মীর মিছিলে পুলিশের গুলিতে পল্টন এলাকায় ঢাকা মহানগর যুবদল নেতা নবীন হোসেন তালুকদার মারা যান। এ ঘটনায় তাঁর স্ত্রী রুমা আক্তার ২১ আগস্ট পল্টন থানায় শেখ হাসিনাসহ ১৫ জনের নাম উল্লেখ করে মামলার আবেদন করেন। মহানগর দক্ষিণ যুবদলের সাবেক আহ্বায়ক গোলাম মাওলা শাহীনের কর্মী নিহত হওয়ায় এ মামলায় তিনি সার্বিক সহায়তা করেন। আর এটাকে অজুহাত হিসেবে দলের একটি সিন্ডিকেট থানা পুলিশকে ওই মামলা নিয়মিত রুজু না করার জন্য বলে। ওই সিন্ডিকেটের দাবি, তাদের উদ্যোগে ওই মামলা করতে হবে।
শুধু ঢাকা নয়, দেশের বিভিন্ন স্থানে করা মামলায়ও বিএনপি নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষকে জড়ানোর অভিযোগ উঠেছে। বরিশালের বাকেরগঞ্জে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে ছাত্রদল নেতাকর্মীর বিরুদ্ধেই মামলা করার অভিযোগ উঠেছে।
নেতাকর্মীরা জানান, বাকেরগঞ্জের নেয়ামতি ইউনিয়ন ছাত্রদল সাধারণ সম্পাদক রাকিব হোসেনকে ছাত্রলীগের কয়েক কর্মী মারধর করে। এ নিয়ে থানায় মামলা করতে গেলে তা বিএনপি নেতারা আটকে দেন। পরে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের সহায়তায় মামলা গ্রহণ করলেও পাল্টা হিসেবে ওই দিনই ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে একটি মামলা করা হয়। থানা পুলিশ জানিয়েছে, ঢাকা থেকে ছাত্রদলের একজন কেন্দ্রীয় নেতা ফোন করে ছাত্রলীগের ওই মামলা নিতে বলা হয়েছে।
সাতক্ষীরা জেলা বিএনপির ক্রীড়া সম্পাদক প্রয়াত আশরাফ হোসেনের সহধর্মিণী ফারজানা রহমান ও তাঁর সন্তানকে মারধর করে বাসা থেকে উচ্ছেদ করেন জেলা কৃষক দলের আহ্বায়ক সালাহউদ্দিন লিটন। চার তলার ওই ভবনটি ২০১৬ সালে ৮৭ লাখ টাকায় বায়না সূত্রে কেনেন ফারজানার দ্বিতীয় স্বামী হাফিজুর রহমান। এতদিন ওই সম্পত্তি বুঝিয়ে না দিয়ে নানা টালবাহানা করেন লিটন।
তবে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গভীর রাতে ফারজানার বাসায় গিয়ে লিটন ও তাঁর স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস ঊর্মি বাসা ছাড়ার জন্য হুমকি দেন। তবে বাসা না ছাড়ায় পরদিন দুপুরে নেতাকর্মী নিয়ে টেনেহিঁচড়ে ও মারধর করে তাঁকে বাসা থেকে বের করে দেন এবং ওই ভবন দখল করেন। এ বিষয়ে থানায় মামলা করতে গেলেও মামলা নেয়নি সদর থানা পুলিশ। দলের একজন প্রয়াত নেতার স্ত্রীর সম্পত্তি দখলের বিষয়ে সালাহউদ্দিন লিটন বলেন, এটা তাঁর সম্পত্তি। বায়নার টাকা ফেরত দেওয়া হয়েছে। যদিও টাকা ফেরতের কোনো ডকুমেন্ট দেখাতে পারেননি লিটন।