যুক্তরাষ্ট্রের মাটি থেকে ফের অভিবাসী তাড়ানোর অঙ্গীকার করে সমালোচনার জন্ম দিয়েছেন আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প। শুক্রবার লস অ্যাঞ্জেলেসের কাছে অবস্থিত নিজস্ব মালিকানার এক অবকাশকেন্দ্রে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন তিনি। ট্রাম্প বলেন, আমি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে হাইতির অভিবাসীদের যুক্তরাষ্ট্র থেকে তাড়িয়েই ছাড়ব। উল্লেখ্য, প্রথম দফা মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময়ও অভিবাসী তাড়ানোর কথা বলেন সাবেক এই মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
ট্রাম্প বলেন, ‘ওহাইও অঙ্গরাজ্যের স্প্রিংফিল্ড শহরের সব অবৈধ অভিবাসীদের দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে।’ কোনো তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত নির্বাচনী বিতর্কে হাইতির অভিবাসীদের বিষয়ে এক অদ্ভুত অভিযোগ তোলেন ট্রাম্প। তিনি দাবি করেন, স্প্রিংফিল্ড শহরের অভিবাসীরা স্থানীয়দের পোষা প্রাণীদের ধরে খেয়ে ফেলছে।
স্প্রিংফিল্ডে প্রায় ১৫ হাজার হাইতি থেকে আসা অভিবাসী রয়েছেন, যাদের অধিকাংশই বৈধ পন্থায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এসেছেন। এতদিন ট্রাম্প সাধারণত অবৈধ অভিবাসীদের তাড়ানোর হুমকি দিয়ে আসছিলেন। কিন্তু এবার ‘কুকুর-বেড়াল খেয়ে ফেলছে’ অভিযোগ নিয়ে তিনি সব অভিবাসীদের ওপর চড়াও হলেন।
তার এমন ‘খোঁড়া’ যুক্তি নিয়ে দেশজুড়ে উপহাস চললেও, স্প্রিংফিল্ডের অভিবাসীরা নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। এক অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির দুই দিন ধরে টানা বোমা হামলার হুমকিতে শহরের মোট তিনটি স্কুল শুক্রবার বন্ধ ঘোষণা করা হয়, যেখানে হাইতিয়ান অভিবাসীদের সন্তানরা পড়াশোনা করে।
এদিকে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস বলেছেন, প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে তিনি নির্দিষ্ট ফেডারেল চাকরিতে কলেজ ডিগ্রির (স্নাতক) বাধ্যবাধকতা তুলে দেবেন। তার মতে ডিগ্রি দিয়ে মানুষের দক্ষতা মাপা যায় না। শুক্রবার পেনসিলভানিয়ায় দেওয়া এক বক্তব্যে কমলা হ্যারিস এসব কথা বলেন। ৫ নভেম্বর অনুষ্ঠেয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির হয়ে লড়ছেন কমলা।
শুক্রবার তিনি তার বক্তব্যে বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নিলে আমি কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরিতে ডিগ্রির বাধ্যবাধকতাসংক্রান্ত এই অপ্রয়োজনীয় বিষয়গুলো বাদ দেব। যেসব মানুষের চার বছরের ডিগ্রি নেই, তাদের জন্য কাজের সুযোগ বাড়াতে এমন পদক্ষেপ নেওয়া হবে। খবর আলজাজিরা, বিবিসি ও সিএনএন অনলাইনের।
অভিবাসীদের প্রতি ট্রাম্পের এমন বিদ্বেষমূলক আচরণে উদ্বেগ প্রকাশ করে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেন, ‘যা-ই হচ্ছে, মারাত্মক ভুল হচ্ছে। আমেরিকায় এসবের স্থান নেই। তিনি (ট্রাম্প) যা করছেন, তা থামাতে হবে। অবশ্যই থামাতে হবে।’ যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত হাইতি সম্প্রদায়ের নেতারা বলেন, রিপাবলিকান প্রার্থীর এমন মন্তব্যের কারণে তাদের নিরাপত্তা ক্ষুণœ হতে পারে।
বিশেষত স্প্রিংফিল্ডের পরিস্থিতি আরও অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে। এ বিষয়ে শহরটির মেয়র রব রুয়ে বলেন, ‘আমাদের বিদ্বেষ নয়, সহমর্মিতা দরকার। শহরে পোষা প্রাণী খেয়ে ফেলার মতো ঘটনার বিশ্বাসযোগ্য কোনো অভিযোগ তারা এখনো পাননি বলে জানিয়েছেন স্প্রিংফিল্ড নগর কর্তৃপক্ষের মুখপাত্র ক্যারেন গ্রেভস।
অভিবাসীদের লক্ষ্য করে কোনো বিদ্বেষমূলক অপরাধ সংঘটনের বিষয়েও তিনি অবগত নন বলেও জানান। ২০২৩ সালের শুরুর দিকে ইউএস সেন্সাস ব্যুরো প্রকাশিত জরিপে দেখা গেছে, ২৫ বছর বা তার বেশি বয়সী মার্কিন নাগরিকদের মধ্যে ৬২ শতাংশের বেশি মানুষের স্নাতক ডিগ্রি নেই। ২০২০ সালে ভোটারদের প্রতি পাঁচজনের মধ্যে তিনজনেরই কলেজ ডিগ্রি ছিল না।
বেসরকারি খাতগুলোকেও একই রকম পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানাবেন বলে উল্লেখ করেন কমলা। কমলা বলেছেন, ডিগ্রি থাকা মানেই ওই ব্যক্তি দক্ষ, এমনটা নয়। কমলা হ্যারিস এবং রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প দুজনই বিভিন্ন অর্থনৈতিক প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোটারদের কাছে টানার চেষ্টা করছেন। কমলা বলেছেন, তিনি মধ্যবিত্তদের জন্য কর কমাতে চান।
আর ট্রাম্প বলছেন, তিনি প্রেসিডেন্ট হলে ওভারটাইম ফির (নির্দিষ্ট সময় শেষে অতিরিক্ত সময়ের কাজের জন্য ভাতা) ওপর কর কমাবেন। তারা দুজনই বকশিশ হিসেবে পাওয়া অর্থের ওপর থেকে কর বাদ দেবেন। কমলা পেনসিলভানিয়ার উইলকস ব্যারেতে বক্তব্য দেওয়ার সময় গাজায় ইসরাইলের হামলায় মার্কিন সহায়তার বিরোধিতাকারীরা হট্টগোল করে।
গাজায় যুদ্ধ বন্ধ এবং ইসরাইলকে অস্ত্রের চালান দেওয়ার ওপর কড়াকড়ি আরোপের দাবিতে কয়েক মাস ধরেই যুক্তরাষ্ট্রে বিক্ষোভ হচ্ছে। শুক্রবার দেওয়া বক্তব্যে আবারও গাজায় যুদ্ধবিরতি এবং জিম্মি মুক্তি চুক্তির বিষয়ে নিজের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেন কমলা। তিনি বলেন, ‘জিম্মি মুক্তি চুক্তি এবং যুদ্ধবিরতির সময় হয়েছে।’
এ সময় বিক্ষোভকারীরা হট্টগোল শুরু করলে কমলা তাদের থামিয়ে দিয়ে বলেন, ‘আমি আপনাদের কণ্ঠস্বরকে শ্রদ্ধা করি। তবে এ মুহূর্তে আমি কথা বলছি। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে কমলা ও ট্রাম্পের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলছে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, মুসলিম এবং আরব আমেরিকান ভোটাররা যদি এবার কমলাকে ভোট না দেন তবে তা তার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা কমিয়ে দেবে।
গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মুসলিম এবং আরব আমেরিকানরা ব্যাপকভাবে ডেমোক্র্যাটিক পার্টিকে ভোট দিয়েছিল। আসন্ন নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থী ট্রাম্পকে সমর্থন দেবেন পঞ্চাশ বছরের কম বয়সী প্রতি চারজনের একজন কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষ; সম্প্রতি এনএএসিপির এক জরিপে এমন তথ্য উঠে এসেছে। দীর্ঘদিন ধরে ডেমোক্র্যাটদের সবচেয়ে অনুগত ভোটার কৃষ্ণাঙ্গরা।
তবে ডেমোক্র্যাটিক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রেসিডেন্সির মেয়াদকালে কিছু অল্প বয়সী কৃষ্ণাঙ্গ ও সব বয়সী পুরুষ কৃষ্ণাঙ্গ ভোটার ক্ষমতাসীন দলটির প্রতি আস্থা হারিয়েছেন। ২০২০ সালে বাইডেনের হোয়াইট হাউজ জয়ের পেছনে কৃষ্ণাঙ্গ ভোটারদের বেশ বড় একটা ভূমিকা ছিল। সেই পথ ধরেই ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস ৫ নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ের জন্য কৃষ্ণাঙ্গদের সমর্থন সুরক্ষিত করতে চেয়েছিলেন।
৬ আগস্ট থেকে ১২ আগস্ট পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে এক হাজার নিবন্ধিত কৃষ্ণাঙ্গ ভোটারের সাক্ষাৎকার নেওয়া এনএএসিপির জরিপে দেখা গেছে, ৬৩ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ ভোটার হ্যারিসকে সমর্থন করার পরিকল্পনা করছেন আর ট্রাম্পকে ১৩ শতাংশ। তবে ৫০ বছরের কম বয়সী ২৬ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ জানিয়েছেন, তারা ট্রাম্পকে সমর্থন করবেন। এ বয়সী ৪৯ শতাংশ হ্যারিসের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন।
তবে পঞ্চাশোর্ধ্ব কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষদের ক্ষেত্রে হ্যারিসকে সমর্থনকারীরা সংখ্যা ৭৭ শতাংশ। ৬৭ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ নারী বলেছেন, তারা হ্যারিসকে সমর্থন করছেন; আর ৮ শতাংশ বলেছেন তারা ট্রাম্পকে সমর্থন দেবেন। জরিপে দেখা গেছে, কৃষ্ণাঙ্গ ভোটারদের জন্য প্রধান ইস্যু হল অর্থনীতি, অপরাধ ও জননিরাপত্তা। তাদের জন্য সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক চাপ হয়ে এসেছে খাদ্য ও খুচরা পণ্যের মূল্য, বাড়ি বাড়া ও ইউটিলিটি বিল।
৫০ বছরের কম বয়সী কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষদের মধ্যে ৮২ শতাংশ আর সব বয়সী ৭৫ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ নারী অর্থনৈতিক দশাকে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা বলে চিহ্নিত করেছেন। জরিপে দেখা গেছে, ভোটারদের কাছে পাঠানো বার্তার যেগুলোতে ‘অধিকার হরণ করা হচ্ছে’ বলে জোর দেওয়া হয়েছে, সেগুলোই সিদ্ধান্তহীন ভোটার ও কৃষ্ণাঙ্গ তরুণদের সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করতে পারে।
আসন্ন নির্বাচনের আগে কমলা হ্যারিসের সঙ্গে আর কোনো টেলিভিশন বিতর্কে অংশ নেবেন না বলে জানিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি বলেন, ‘যখন কেউ লড়াইয়ে হেরে যায়, তখন তার মুখ থেকে প্রথমেই বের হয়—আমি আবার নতুন করে লড়াই করতে চাই। বৃহস্পতিবার নিজের মালিকানাধীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে এমন ঘোষণা দেন রিপাবলিকান দলের এই প্রার্থী।
ট্রাম্প লিখেন, ‘তৃতীয় কোনো বিতর্ক অনুষ্ঠিত হবে না।’ প্রথম বিতর্ক বলতে তিনি বুঝিয়েছেন গত জুন মাসে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে তার বিতর্ককে। ডেমোক্র্যাটিক দলের প্রার্থিতা ছেড়ে দেওয়ার পর বাইডেনের জায়গায় আসেন ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস। মঙ্গলবার রাত ৯টায় যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া অঙ্গরাজ্যের ফিলাডেলফিয়ায় এবিসি নিউজের আয়োজনে বিতর্কে অংশ নেন ডোনাল্ড ট্রাম্প ও কমলা হ্যারিস।
ওই বিতর্ক টেলিভিশনে দেখেছেন ৬ কোটি ৭০ লাখ মানুষ। বিতর্কের পর পরই কমলার প্রচার শিবির জানায়, আগামী অক্টোবরে ট্রাম্পের সঙ্গে আবার বিতর্কের মঞ্চে মুখোমুখি হতে চান কমলা। ট্রাম্পও তখন বলেছিলেন, টেলিভিশন চ্যানেল এনবিসি ও ফক্সে বিতর্কের জন্য প্রস্তুত তিনি। তবে এবার সিদ্ধান্ত বদলের কথা জানিয়েছেন রিপাবলিকান দলের এই প্রার্থী। তিনি বলেন ‘জরিপে এটা স্পষ্ট যে, মঙ্গলবার রাতে ডেমোক্র্যাটিক দলের উগ্র-বামপন্থি প্রার্থী কমরেড কমলা হ্যারিসের বিরুদ্ধে আমি জিতেছি।
আর তিনি এর পরই আবার বিতর্কের আহ্বান জানান। যখন কেউ লড়াইয়ে হেরে যায়, তখন তার মুখ থেকে প্রথমেই বের হয়Ñ আমি আবার নতুন করে লড়াই করতে চাই। তবে বিতর্কে ট্রাম্প কমলাকে হারানোর কথা বললেও জরিপে ভিন্ন চিত্র দেখা যায়। সিএনএনের একটি জরিপ বলছে, বিতর্কে ট্রাম্পের তুলনায় বেশ ভালো করেছেন কমলা। জরিপে তার পয়েন্ট ৬৩। অন্যদিকে ট্রাম্পের ৩৭। আর ইউগভের জরিপ অনুযায়ী, বিতর্কে কমলা ও ট্রাম্পের পয়েন্ট যথাক্রমে ৪৩ ও ৩২।