আসমা নীরা। একটি নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। রাজধানীর গোপীবাগে পরিবারের সঙ্গে ভাড়া বাসায় থাকে। বাবা মতিঝিলে একটি বাণিজ্যিক কোম্পানি আপিসে মাঝারি বেতনে চাকরি করেন। নীরা একটা ইউনিভার্সিটি কলেজে পড়ে। তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি সহশিক্ষার।
ছেলেমেয়ে একত্রে পড়ার ব্যবস্থা সেখানে। জুলাইয়ের ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে নীরা সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিল। পথে নেমেছিল ঝুঁকি নিয়ে। ছোটভাই মিলুকে সঙ্গে করে মিছিলে, মানববন্ধনে ও অবস্থান কর্মসূচিতে শামিল হয়েছে সে।ছাত্রলীগের অত্যাচার ও বাড়াবাড়ি এবং মেয়েদেরকে ক্রমাগত অসম্মান করায় নীরা ছিল প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ। মনে মনে সে এর প্রতিকার চাইতো সব সময়। রাজপথ উত্তাল হয়ে ওঠায় নীরাও নেমে আসে। এই আন্দোলনকে সে ছাত্রলীগের মাস্তানির উপযুক্ত জবাব বলেই ধরে নিয়েছিল।
মিরপুরের একটি মসজিদের মোয়াজ্জিন আব্দুস সবুর। মসজিদের পাশেই একটা মেসবাড়িতে থাকতেন। স্ত্রী ও একমাত্র কন্যা চাঁদপুরে গ্রামের বাড়ি থাকে। মাসে একবার করে বাড়ি যান মৌলভি সবুর। হাসিনার আওয়ামী রেজিমকে খুব ইসলাম-বিদ্বেষী বলে মনে করতেন তিনি। এই আমলে নাস্তিকদের দৌরাত্ম্য বেড়েছে, নারীদের অনেকে বেপর্দা হয়েছে বলে তিনি বিশ্বাস করতেন। আলেমদের ওপর অত্যাচার হয়েছে বেপরোয়া। মসজিদের খুৎবা ও ওয়াজ মাহফিলের ওপর কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। ছাত্রদের আন্দোলন মৌলভি সাহেবের কাছে ছিল ইসলাম-বিদ্বেষী সরকারকে কড়া জবাব দেওয়ার একটা মোক্ষম সুযোগ। তাই তিনিও নেমে এসেছিলেন পথে। পুলিশের হামলায় রক্তাক্ত ও গুরুতর জখম হয়েও তিনি পিছপা হননি।
মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডের বাসিন্দা আদনান ছাত্রদল কর্মী। শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া সে। এলাকায় প্রকাশ্যে ছাত্রদলের পরিচয় দেয়ার কোনো সুযোগ তার ছিল না। দলীয় কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে কতোবার মহল্লার যুবলীগ মাস্তান ও পুলিশের দৌড়ানি খেতে হয়েছে৷ একবার ধরে থানায়ও নিয়ে গিয়ে তাকে খুব মারধর করেছিল। ছাড়িয়ে আনতে পুলিশকে দেড় লাখ টাকা ‘ইনাম’ দিতে হয়েছিল পরিবারকে। এরপর থেকে তার পরিবার তটস্থ থাকতো। এলাকায় রাজনৈতিক কোনো গোলযোগ হলেই বুক কাঁপতো তাদের; গায়েবি মামলায় পুলিশ আবার আদনানের নাম ঢুকিয়ে দেয় কিনা। জুলাইয়ের ছাত্র আন্দোলনে বিএনপি নৈতিক সমর্থন দিয়েছিল। ছাত্রদলের কোনো সুস্পষ্ট নির্দেশনা না পেলেও আদনান এ আন্দোলনে মরিয়া হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ঝুঁকি নিয়ে সে ও তার বন্ধুরা অনেক সাহসী তৎপতা চালিয়েছে। এবার এসপারওসপার কিছু একটা করে ফেলতেই হবে। এই ছিল তাদের দৃঢ় প্রতিজ্ঞা।
বংশালে ওয়েল্ডিং মেশিনের কিশোর কর্মচারী তৌহিদের বয়স ১৫। হাসিনা রেজিমের আমলে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের আকাশছোঁয়া দাম বাড়ায় তার প্রাণ ওষ্ঠাগত ছিল। তার মতোই গার্মেন্টসকর্মী শিউলি ও হাসান, ভ্রাম্যমাণ চা-বিক্রেতা সালাম, ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার এজেন্টের বিল কালেক্টার সুমন সবাই একই রকম অভিজ্ঞতা থেকে মুক্তির লক্ষ্যে আন্দোলনে নিজেদেরকে অংশীদার করেছিল।
শনির আখড়ার মাদরাসা ছাত্র জুবায়ের ও তার বন্ধুরা তাদের মুহতামিমের হুকুমে রাজপথের আন্দোলনে শরিক হয়ে পুলিশ ও সরকারি দলের গুন্ডাদের সঙ্গে খন্ডযুদ্ধ করেছে। ইসলাম বাঁচাতে ও আলেম সমাজের সম্মান রক্ষায় আওয়ামী সরকারকে উৎখাত করা তারা অপরিহার্য কর্তব্য মনে করেছে।
বামপন্থী নাট্যকর্মী শোয়েব ও বীথিও আন্দোলন করেছেন কারণ, তারা বুঝেছিলেন, আওয়ামী লীগ দেশে ফ্যাসিবাদ কায়েম করেছে। এই ফ্যাসিবাদের উচ্ছেদ ছাড়া শিল্প-সাহিত্যের বিকাশ এবং মুক্তমতের অবাধ প্রকাশ সম্ভব নয়।
ছাত্রশিবিরের সাজ্জাদ ও হুজাইফা আন্দোলনে নেমেছিল জীবন বাজি রেখে। তাদের ছাত্র সংগঠন ও মূল রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল হাসিনা রেজিম। তাদের বড় বড় নেতাদেরকে মুক্তিযুদ্ধকালীন যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে প্রশ্নবিদ্ধ বিচারে ফাঁসি দেওয়া হয়। কোনো ছাত্রাবাসে তারা থাকতে পারেনি। পরিচয় নিয়ে সন্দেহ হলেই তাদের কর্মীদের ছাত্রলীগ পিটিয়ে মেরে ফেলতো। তারা নগরপ্রান্তে বিভিন্ন এলাকায় মেস করে থাকতো। সেখানেও হানা দিয়ে ধরে নিয়ে গিয়ে অকথ্য নির্যাতন চালাতো পুলিশ। এই নারকীয় পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে তারা যে কোনো মূল্যে হাসিনা রেজিমের উচ্ছেদ চাইতো।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কাওসার এবার প্রথম ভোটার হয়েছে। গত জানুয়ারিতে সংসদ নির্বাচনে সে ভোট দিতে যায় অনেক উৎসাহ নিয়ে। ভোটকেন্দ্রের বাইরে কিছু বখাটে তরুণ ভোটার স্লিপ দিচ্ছিল। তাদেরই একজন, যার শার্টের বোতাম খোলা ও গলায় মোটা চেইনের সঙ্গে চ্যাপ্টা তাবিজ ঝোলানো ছিল। সে পান চিবুতে চিবুতে কাওসারকে তুই তোকারি করে বলে, ‘তোর ভোট তো দেয়া হয়ে গেছে।’ কাউসার প্রতিবাদ করলে ওরা কয়েকজন মিলে তাকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়। একজন পিস্তল তাক করে বলে, “কথা কৈলে এক্কেবারে ছ্যাদা কইরা ফালামু।” এসময় একজন পুলিস ও দু’জন আনসার সদস্য এ দৃশ্য দেখে দাঁত বের করে হাসছিল। সেই অপমান কাওসার ভুলতে পারেনি। তার ফিয়াঁসে ও সহপাঠী শায়লার অভিজ্ঞতাও প্রায় একই রকম। তারা দু’জনেই জুলাইয়ের আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে।
যুবদলের তৃণমূল পর্যায়ের নেতা শাহ্আলম বাড্ডায় থাকেন। কোটাবিরোধী আন্দোলনকে তিনি প্রথমে সন্দেহের চোখে দেখতেন। ভাবতেন রাজনৈতিক আন্দোলনকে বিপথগামী করতে এরা সরকারের কোনো বি-টিম হতে পারে। কিন্তু যখন পুলিশ সরাসরি বুকে গুলি চালিয়ে এবং হেলিকপ্টার থেকে ব্রার্স্ট ফায়ার করে ছাত্র-তরুণদের ওপরে হত্যাযজ্ঞ চালাতে শুরু করলো তখন শাহআলম সিদ্ধান্ত নিলেন, না, এভাবে চুপ থাকা যাবে না। কিন্তু তার নিজের সংগঠনের নেতাদের সংগে যোগাযোগ করতে পারছিলেন না তিনি। স্বেচ্ছাসেবক দলের এক বড় নেতা পল্টন থাকেন। তার সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। তিনি জানালেন, “ভাইয়া লন্ডন থেকে নির্দেশ দিয়েছেন প্রত্যেককেই স্থানীয়ভাবে সমন্বয় করে আন্দোলনে নামতে হবে। তবে কোনোভাবেই দলীয় পরিচয় যেন প্রকাশ না পায়।” শাহআলম নেমে গেলেন। তিনি তার সংগঠনের সঙ্গীদের নিয়ে ছাত্রদের ওপর পুলিশের হামলা প্রতিহত করতে শুরু করলেন।
শফিকের বাবা পুলিশ অফিসার। সানজানার বাবা সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল। উভয়ের বাবাই হাসিনা রেজিমের বেনিফিশিয়ারি ও কট্টর সমর্থক। আন্দোলন দমনে তাদের ভূমিকা ছিল নিষ্ঠুর। দু’জনের মা-ই শিক্ষিকা। শফিক ও সানজানাকে তাদের বন্ধুরা খুব লজ্জা দিতো তাদের বাবার ভূমিকার জন্য। কিন্তু দু’জনের মা-ই তাদের সন্তানের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। মায়ের সমর্থন পেয়েই ওরা দু’জনেই আন্দোলনে অংশ নেয়।
সাহেল কখনো রাজনীতি করেনি। সে ভালো ছাত্র। পড়াশুনা নিয়ে মেতে থাকতো। এছাড়া বিতর্ক তার প্রিয় প্রসঙ্গ। ডিবেটিং সোসাইটির মেম্বার ছিল সে। প্রথম দিকে আন্দোলনের দিকে তার তেমন উৎসাহ ছিল না। কিন্তু যখন ছাত্রদের গুলি করে মারা শুরু হলো তখন তার শান্ত বুকের ভেতরকার রক্তও টগবগিয়ে উঠলো। বুক চিতিয়ে দাঁড়ানো সাঈদকে গুলি করে মারা এবং পানি পান করাতে গিয়ে মুগ্ধ-‘র জীবন দেওয়ার দৃশ্য দেখে সাহেল নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেনি। উথালপাতাল মিছিলে গিয়ে শামিল হয়ে যায় সেও।
আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের এমন গল্পের শেষ নেই। উদাহরণ আছে লক্ষ লক্ষ। তাদের সকলের অভিন্ন লক্ষ্য ছিল, ফ্যাসিস্ট রেজিমের উৎখাত। তবে এই উৎখাত চাইবার কারণ ছিল পৃথক। উদ্দেশ্য ছিল আলাদা। প্রতিটি জাতীয় বিপ্লব বা অভ্যুত্থানে তাই হয়। বিভিন্ন কারণে বিভিন্ন মানুষ ও জনগোষ্ঠী স্বৈরাচার-বিরোধী হয়ে ওঠে। তারা তাদের বিভিন্ন উদ্দেশ্য হাসিল বা কর্মসূচির বাস্তবায়ন চায়। তার জন্য তারা স্বৈরশাসনের উচ্ছেদ চায়। এভাবেই নানা কারণে, নানা স্বার্থে, নানা উদ্দেশ্যে মানুষ স্বৈরাচার উৎখাতের আন্দোলনে শামিল হয়। তারা জনে জনে মিলে হয়ে ওঠে ফ্যাসিস্ট-বিরোধী জনতা।
এই যে ফ্যাসিস্ট-বিরোধী আন্দোলনে নানান স্রোতধারা এসে একবিন্দুতে মিলে যায়, দুর্দমনীয় শক্তি হয়ে ওঠে, আন্দোলনকে জাতীয় বিপ্লব বা জাতীয় অভ্যুত্থানে উন্নীত করে, আন্দোলনের বিজয়ের পর তা’ কি আর একবিন্দুতে থাকে? না, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই থাকে না। শুধু স্বৈরাচার উৎখাতই যাদের অভীষ্ট লক্ষ্য ছিল তারা লক্ষ্য পূরণ হওয়ায় তখন নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। আর অন্যান্য লক্ষ্য নিয়ে যারা স্বৈরাচার হটাবার আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল তারা তাদের নিজ নিজ লক্ষ্য অর্জনে সচেষ্ট হয়। একই সাথে প্রতিটা পক্ষই অপর পক্ষের লক্ষ্য পূরণে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে। ফলে অধিকাংশ জাতীয় বিপ্লবের সাফল্যের পর একটা অনৈক্য সৃষ্টির আশঙ্কা থেকেই যায়। সেই অনৈক্য বিপ্লবের বিজয়কে ব্যর্থ করে দেবে কিনা তখন তা’ বিপ্লব-পরবর্তী নেতৃত্বের দূরদর্শিতা ও প্রজ্ঞার ওপর নির্ভর করে।
‘চব্বিশের ছাত্র আন্দোলন একটি সীমিত লক্ষ্য নিয়ে শুরু হয়েছিল। এর কোনো ঘোষিত রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল না। পরে ঘটনাপ্রবাহের নানা অভিঘাতে এই আন্দোলন জাতীয় রাজনৈতিক চরিত্র অর্জন করে। একদফার অর্থাৎ ফ্যাসিবাদী হাসিনা রেজিম উৎখাতের আন্দোলনে পরিণত হয় এবং সর্বস্তরের জনসাধারণের অংশগ্রহণে জাতীয় ছাত্র-গণঅভ্যুত্থান রূপে সাফল্য ও বিজয় অর্জন করে। এই পটভূমিতে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর দায়িত্ব অর্পিত হয় বিজয়কে সংহত করে পরবর্তী ধাপে পৌঁছে দেওয়ার।
এখন সে পরবর্তী ধাপটি কী? কেবলই জাতীয় সংসদের একটা সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করে দেওয়া? আমার তা মনে হয় না। এরশাদ-বিরোধী আন্দোলন, আ.লীগ-জাপা-জামায়াতের তত্ত্বাবধায়ক আন্দোলন এবং ২০০৬ সালে হাসিনার লগি-বৈঠার আন্দোলনের কথা আমাদের স্মৃতিতে আছে। প্রতিটা আন্দোলনের পর প্রতিষ্ঠিত নির্দলীয় সরকার একটি নির্বাচন করে রাজনৈতিক দলের নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে চলে গেছে। তাতে কি দেশে গণতন্ত্র দৃঢ়মূল হয়েছে? সুষ্ঠু নির্বাচনের স্থায়ী ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে? রাজনৈতিক বিসম্বাদ এড়িয়ে গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যুগুলিতে ঐকমত্য স্থাপন করা গেছে? স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? কোনোটাই হয়নি। তাহলে এখন একটা নির্বাচন করে রাজনৈতিক দলের সরকারের হাতে ক্ষমতা দিয়ে দিলেই সব সুরাহা হয়ে যাবে এমন ভাবার কারণ নেই। তাই ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংস্কার করে একটি সর্বসম্মত নির্বাচন পদ্ধতি ও কাঠামো প্রবর্তন করতে হবে। এরসঙ্গে পুলিশ, জনপ্রশাসন, বিচার বিভাগ ও বিধিবদ্ধ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার অপরিহার্য। এ সব কিছুর সঙ্গেই প্রজাতন্ত্রের সংবিধান ওতপ্রোতোভাবে জড়িত। কাজেই সাংবাবিধানিক সংস্কার ছাড়া কোনো সংস্কারই অর্থবহ হবে না।
আমরা আমাদের অতীতের দিকে তাকালে আরো কিছু জ্বলন্ত প্রশ্নের মুখে পড়ে যাই। অতীতের রাষ্ট্রবিপ্লবকে ব্যক্তিগত হত্যাকাণ্ড আখ্যা দিয়ে পরিবর্তনের রূপকারদের পরবর্তীতে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার অভিজ্ঞতা আমাদের আছে। পরবর্তীকালের সাংবিধানিক রাজনীতি আর সেই রাষ্ট্রবিপ্লবের পক্ষে অবস্থান নেয়নি। ফ্যাসিবাদের অজস্র ক্ষতচিহ্নে কলঙ্কিত বর্তমান সংবিধানেও চব্বিশের পরিবর্তনের সামরিক-বেসামরিক রূপকারদের একইভাবে সাজা দেওয়ার বন্দোবস্ত রয়ে গেছে। তাদের ভাগ্য কি ভবিষ্যতের রাজনীতির হাতে ছেড়ে দেওয়া হবে নাকি এখনই সংবিধানকে বিপ্লবানুগ করা হবে – সেই প্রশ্নের সন্তোষজনক মীমাংসাটা দরকার।
গণতন্ত্রকে রাষ্ট্র পরিচালনা পদ্ধতি হিসেবে গ্রহণের সর্বজনীন জাতীয় অঙ্গীকারে আবদ্ধ হতে হবে আমাদেরকে। সেই অঙ্গীকারে অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে ফ্যাসিবাদের বিরোধিতা ও মতবৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের সন্ধানের প্রয়াস। অর্থাৎ এই রাষ্ট্রকে টেকসই গণতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদ-বিরোধী জাতীয় ঐক্যমতকে স্থায়ীভাবে ধারণে সক্ষম করে সাজাতে হবে। না হলে একদিনের ভোটের গণতন্ত্র ফিরিয়ে এনে কোনো লাভই হবে না। বাংলাদেশের নিকট অতীতই সে সাক্ষ্য বহন করছে।
তবে সংস্কার একটি অন্তহীন, অনিঃশেষ ও ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। কাজেই গণতন্ত্রায়নের জন্য বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে অনন্তকালের জন্য দায়িত্বে রাখার কোনো সুযোগ নেই। প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষ করে একটা নির্বাচনের আয়োজনের ব্যাপারে খসড়া সময়সীমা সম্বলিত একটা রোডম্যাপ তাদের খুব তাড়াতাড়িই ঘোষণা করা উচিত। আমার নিজের ধারণা, এ কাজে অন্তর্বর্তী সরকারের দুই-আড়াই বছর সময় লাগতে পারে। সেই সময়সীমাটা ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্ধারণ ও ঘোষণা করলে পরবর্তী নির্বাচনে ক্ষমতাসীন হবার ব্যাপারে আশাবাদী বড় দলগুলোকে সংশয়, সন্দেহ ও অবিশ্বাস থেকে মুক্ত করা যায়। তখন তারাও সংস্কারের কাজে সহযোগিতার হাত বাড়াতে সাচ্ছন্দ্য বোধ করবে।
আমাদেরকে মনে রাখতে হবে যে, ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার পুনরুত্থানের আশংকাহীন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাই আমাদের মূল লক্ষ্য। সেই লক্ষ্য অর্জনে একটি সক্ষম রাষ্ট্রকাঠামো গড়ে তোলার জন্য সংস্কার কর্মসূচির বাস্তবায়ন আমাদের উপলক্ষ। রাষ্ট্রের সংস্কার ছাড়া গণতন্ত্র টেকসই হবে না, নির্বাচন অর্থবহ হবে না। তবে সংস্কারকে যেন নির্বাচনকে অহেতুক বিলম্বিত করার ছুতায় পরিণত করা না হয়। তাহলে সংস্কার, নির্বাচন ও গণতন্ত্র সবই ব্যর্থ হয়ে যাবে।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও লেখক