শারীরিক গঠন যেমনই হোক না কেনো, অতিরিক্ত চর্বি ভালো নয়। আর পেটের চারপাশে চর্বি জমে বেলুনের মতো ফুলে যাওয়া দেহের জন্য আরও ক্ষতিকর।
“দেহের চামড়ার নিচে জমা চর্বিকে বলা হয় ‘সাবকিওটেনিয়াস ফ্যাট’। বেশিরভাগ মানুষের ৯০ ভাগ চর্বি এখানেই থাকে। বাকি ১০ ভাগ চর্বি থাকে যকৃত, নাড়িভুঁড়ি ও পেটের ভেতর অন্যান্য অঙ্গের মাঝে ফাঁকা জায়গাগুলোতে। যাকে বলা হয় ‘ভিসেরল ফ্যাট’। এছাড়া পেটের পেশি ও নাড়িভুঁড়ির মাঝে কম্বলের মতো একটা আবরণ থাকে, যাকে বলা হয় ‘ওমেন্টাম’। এখানেও চর্বি জমে এই আবরণ শক্ত ও পুরু হয়ে যায়”- ব্যাখ্যা করেন বস্টন’য়ের ‘ব্রিঘাম অ্যান্ড উইম্যান’স হসপিটাল’য়ের চিকিৎসক হাওয়ার্ড ই. লিওয়াইন।
হার্ভার্ড হেল্থ পাবলিকেশন’য়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে তিনি আরও বলেন, “দেহের অল্প জায়গা জুড়ে থাকলেও নানান রোগ তৈরির মূল কারণ এই ‘ভিসেরল ফ্যাট’। পুরুষদের চাইতে বিশেষ করে নারীদের মধ্য বয়সের পর থেকেই পেটে চর্বি জমতে দেখা যায়। এমনকি ওজন না বাড়লেও কোমড়ের মাপ বাড়তে পারে।”
পেটের চর্বির সমস্যা
দেহের চর্বি সাধারণত শক্তি খরচের জন্য জমা হয়। তবে পেটের চর্বির কোষ জৈবিকভাবে সক্রিয়।
ডা. হাওয়ার্ড বলেন, “ভিসেরল ফ্যাট’ থেকে এক ধরনের হরমোন ও ক্ষুদ্র কণা নিঃসরণ ঘটে; যা দেহের অন্যান্য কোষকলায় প্রভাব ফেলে।”
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, এই পেটের চর্বি ফ্যাটি অ্যাসিড নিঃসরণের মাধ্যমে রক্তে ও যকৃতে কোলেস্টেরলের মাত্রা বৃদ্ধি করে। এছাড়া ‘কিটোকিন্স’ নামক প্রোটিন তৈরির মাধ্যমে স্বল্প মাত্রার প্রদাহ বাড়ায়, ফলে হৃদরোগসহ অন্যান্য দীর্ঘমেয়াদি রোগ হওয়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।
চর্বি থেকে যত রোগ
দেহের সার্বিক স্থূলতার চাইতে শুধু পেটের চর্বি এককভাবে নানান রোগের জন্য দায়ী।
হৃদসংক্রান্ত রোগ: গবেষণায় দেখা গেছে, যাদের কোমরের মাপ বেশি তাদের হৃদরোগ হওয়ার ঝুঁকি অন্যান্য মানুষদের তুলনায় দ্বিগুন। এছাড়া হৃদ-সংক্রান্ত অন্যান্য রোগ যেমন- উচ্চ রক্তচাপ, রক্তের শর্করা বৃদ্ধি, ভালো কোলেস্টেরলের মাত্রা কমা, ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ায়।
ডিমেনশা বা স্মৃতিভ্রংশ রোগ: মার্কিন স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান ‘কাইজার পার্মানেনটে’র করা গবেষণায় দেখা গেছে, বয়স চল্লিশের আগে অন্যান্যদের তুলনায় যাদের অতি মাত্রায় পেটের চর্বির ছিল, তাদের ডিমেনশা’তে ভোগার সম্ভাবনা বেড়েছে তিনগুন। বিশেষ করে ৭০ এবং ৮০ বছর বয়সে।
অ্যাজমা বা শ্বাস কষ্ট: ক্যালিফোর্নিয়া’র শিক্ষকদের ওপর করা গবেষণা বলে, যাদের কোমরের মাপ তুলনামূলক কম তাদের থেকে কোমরের পরিধি যাদের ৩৫ ইঞ্চির ওপর তাদের শ্বাস কষ্টে ভোগার পরিমাণ ৩৭ শতাংশ বেশি থাকে।
অতিরিক্ত ওজন এই রোগের ঝুঁকি আরও বাড়ায়।
স্তন ক্যান্সার: বিভিন্ন গবেষণার গড় ফলাফলে দেখা গেছে, রজোঃবন্ধ হওয়ার আগে যেসব নারীদের কোমরের পরিধি অতিরিক্ত থাকে তাদের স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। এমনকি রজোঃবন্ধের পর স্তন ক্যান্সার হওয়ার সাথে সম্পর্কিত পেটের চর্বি।
মলাশয়ের ক্যান্সার: যাদের ‘ভিসেরল ফ্যাট’ বেশি তাদের মলাশয়ে ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি তিনগুন।
পেটের চর্বি ঝরানো ও প্রতিরোধের পন্থা
বয়স, লিঙ্গ, হরমোন, জন্মের সময় ওজন (ওজন কম শিশুদের পরিণত বয়সে পেটে চর্বি বেশি জমে) ইত্যাদির ওপর কোথায় বেশি চর্বি জমবে সেটা নির্ভর করে।
মা হওয়ার পর নারীদের ‘ভিসেরল ফ্যাট’ হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে।
এসব তথ্য জানিয়ে ডা. হাওয়ার্ড আরও বলেন, “লিঙ্গ, জন্মের সময় ওজন ইত্যাদি বিষয়গুলোতো আর পরিবর্তন করা সম্ভব না। তবে অন্যান্য অনেক পন্থা আছে যেগুলো পালন করলে পেটে চর্বি জমার পরিমাণ কমানো যায়।”
কর্মব্যস্ত থাকা: ব্যায়াম কোমরের মাপ কমায়। এমনকি ওজন না কমালেও পেটের চর্বি ঝরিয়ে পেশি গড়তে সাহায্য করে। সপ্তাহের বেশিরভাগ দিন ৩০ মিনিট দ্রুত হাঁটা বা সাইকেল চালানো চর্বি কমাতে সাহায্য করে।
এছাড়া গাড়িতে চড়ার অভ্যাস থাকলে, দূরে পার্ক করে গন্তব্যে হেঁটে যাওয়া, দুতিন তলা উঠতে সিঁড়ি ব্যবহার, ফোনে কথা বলার সময় হাঁটাহাঁটি করা- এই কৌশলগুলো কার্যকর।
আর ব্যায়াম চালিয়ে গেলে চর্বি পুনরায় জমা বন্ধ হয়।
সঠিক খাদ্যাভ্যাস: সুষম খাবার খাওয়ার অভ্যাস পেটে চর্বি জমা থেকে দূরে রাখে। এছাড়া সরল শর্করা ধরনের খাবার যেমন- মিষ্টি বা কোমল পানীয় গ্রহণ যত কম তত ভালো।
ধূমপান না করা: যত বেশি ধূমপান করা হবে উরু ও নিতম্বের চাইতে পেটে চর্বি জমবে বেশি।
পর্যাপ্ত ঘুম: পাঁচ বা এর কম সময় ঘুমালে পেটে চর্বি জমার ঝুঁকি বাড়ে। তাই অন্তত সাত থেকে আট ঘণ্টা ঘুম নিশ্চিত করতে হবে।
দ্রুত কমানোর পন্থায় না যাওয়া: অনেকেই ‘লাইপোসাকশন’য়ের মাধ্যমে চর্বি দূর করেন। তবে এই পদ্ধতিতে অন্ত্রের দেয়ালে থাকা চর্বি সরাতে পারে না।