আওয়ামী লীগ সরকার পতনে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দাবির মুখে ‘সন্ত্রাসী’ কাজে জড়িত থাকার অভিযোগে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের এই ছাত্র সংগঠনের বিরুদ্ধে কোটা সংস্কার ও সরকার পতন আন্দোলন চলাকালে ছাত্র-জনতা ’হত্যা’ ও অসংখ্য মানুষের ‘জীবন বিপন্ন‘ করা এবং বিভিন্ন সময় ‘সন্ত্রাসী’ কাজে জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয়েছে।
২০০৯ সালের সন্ত্রাসবিরোধী আইন অনুযায়ী ‘সন্ত্রাসী সত্তা‘ হিসেবে তালিকাভুক্ত করে বুধবার প্রজ্ঞাপন জারি করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
এতে বলা হয়েছে, “বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ’-কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করিল এবং উক্ত আইনের তফসিল-২ এ ’বাংলাদেশ ছাত্রলীগ’ নামীয় ছাত্র সংগঠনকে নিষিদ্ধ সত্ত্বা হিসেবে তালিকাভুক্ত করিল।”
প্রজ্ঞাপনে ছাত্রলীগ নিষিদ্ধের কারণ হিসেবে ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ছাত্র সংগঠনটির বিভিন্ন সময়ের ‘সন্ত্রাসী’ কার্যকলাপের বিষয়ে তুলে ধরা হয়।
যে আইনে আওয়ামী লীগ গত ১ অগাস্ট জামায়াতে ইসলামী ও তাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরকে নিষিদ্ধ করেছিল, সেই একই আইনে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করা হল।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা বৃহস্পতিবারের মধ্যে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার হুঁশিয়ারি দিয়েছিল। মঙ্গলবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগের দাবিতে আয়োজিত বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে এ সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়।
নিষিদ্ধ হওয়ার খবর আসার পর বুধবার রাতে এর প্রতিক্রিয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আনন্দ মিছিল করে শিক্ষার্থীরা।
এরপর বুধবার জননিরাপত্তা বিভাগ রাজনৈতিক শাখা-২ থেকে দেশের পুরনো ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
এতে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকালে ১৫ জুলাই থেকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হামলা ও হত্যার অভিযোগ আনা হয়।
বলা হয়, “আন্দোলনরত ছাত্র-ছাত্রী ও সাধারণ জনগণকে উন্মত্ত ও বেপরোয়া সশস্ত্র আক্রমণ করিয়া শতশত নিরপরাধ শিক্ষার্থী ও ব্যক্তিদের হত্যা করিয়াছে এবং আরো অসংখ্য মানুষের জীবন বিপন্ন করিয়াছে।”
একই সঙ্গে প্রজ্ঞাপনে সরকারের নিকট ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরও ছাত্রলীগ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক, ধ্বংসাত্মক ও উস্কানিমূলক কর্মকাণ্ড এবং বিভিন্ন সন্ত্রাসী কাজের সঙ্গে জড়িত ছিল বলে ‘যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ’ থাকার কথা বলা হয়।
ভারত ভাগের পর ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হল থেকে ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’ নাম নিয়ে শুরু করা সংগঠন ধাপে ধাপে পাল্টে স্বাধীনতার পর ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ’ নামধারণ করে।
পাকিস্তান আমলে ছাত্র অধিকার আন্দোলন ও স্বাধিকার আন্দোলনসহ জাতির সংকটকালে রাজপথে ছাত্রলীগ ছিল নেতৃত্বের ভূমিকায়; স্বাধীনতা যুদ্ধে ও দাবি আদায়ের সংগ্রামে ঝরে গেছে বহু নেতাকর্মীর প্রাণ। স্বাধীন বাংলাদেশেও সামরিক শাসনবিরোধী লড়াইয়েও ছাত্রলীগের সোচ্চার ভূমিকা ছিল।
নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পরিস্থিতি পাল্টাতে থাকে। নানা ঘটনায় সমালোচনায় পড়তে হয় সংগঠনটিকে।
২০০৯ সাল থেকে টানা ১৫ বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে কমিটি বাণিজ্য ও চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ নানা অনিয়মে সংগঠনটির নাম জড়ায়।
চাঁদাবাজির অভিযোগে ২০১৯ সালে সমালোচনার মুখে থাকা সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীকে ছাত্রলীগের নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
২০১২ সালে দর্জি দোকানের কর্মী বিশ্বজিৎ দাস হত্যাকাণ্ড, একই বছর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র জুবায়ের আহমেদ হত্যাকাণ্ড, ২০১৯ সালে বুয়েটে আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের সাজাও হয়েছে।
চলতি বছর জুলাইয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের হামলার পরই বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন সহিংস রূপ পায়। আন্দোলন দমাতে প্রকাশ্যে রাজপথে সংগঠনটির সশস্ত্র কর্মীদের কর্মকাণ্ডের ছবি সংবাদমাধ্যমেও প্রকাশিত হয়।
এ হামলার জন্য ২০২২ সাল থেকে সংগঠনটির নেতৃত্বে থাকা সভাপতি সাদ্দাম হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ (ইনান) এর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়।
সরকার পতনের পর থেকে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীরা ছাত্রলীগ নিষিদ্ধের দাবি জানিয়ে আসছিল। গত কয়েকদিন তাদের দাবি জোরালো হয়।
মঙ্গলবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বিভিন্ন ব্যানার নিয়ে বিক্ষোভ সমাবেশ করে আন্দোলনকারীরা। বিকাল থেকে দলে দলে শহীদ মিনারে জড়ো হন তারা। সেখানে সমাবেশে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ ও সংবিধান বাতিলের পাশাপাশি ছাত্রলীগ নিষিদ্ধসহ পাঁচটি দাবি তুলে ধরেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ।
আগের দিন সোমবার রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধের দাবিতে মশাল মিছিল করেছিল কোটা সংস্কার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
এছাড়া মঙ্গলবার রাষ্ট্রপতির অপসারণের পাশাপাশি ছাত্রলীগ নিষিদ্ধের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে ঘণ্টাব্যাপী অবস্থান কর্মসূচি পালন করে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা কমিটি (স্বারক) নামের এক প্ল্যাটফর্ম।
এমন দাবির মধ্যে বুধবার সরকার প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ২০০৯ সালের সন্ত্রাসবিরোধী আইন অনুযায়ী ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করে।
প্রজ্ঞাপনে স্বাধীনতা পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে বিশেষ করে গত ১৫ বছরে সংগঠনটির ’সন্ত্রাসী’ কর্মকাণ্ডের কথা তুলে ধরে।
এতে বলা হয়, “স্বৈরাচারী শাসনামলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ হত্যা, নির্যাতন, গণরুম কেন্দ্রিক নিপীড়ন, ছাত্রাবাসে সিট বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নসহ নানাবিধ জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী কর্মকান্ডে জড়িত ছিল এবং এতৎসম্পর্কিত প্রামাণ্য তথ্য দেশের সকল প্রধান গণমাধ্যমে প্রকাশিত হইয়াছে এবং কিছু সন্ত্রাসী ঘটনায় সংগঠনটির নেতা-কর্মীদের অপরাধ আদালতেও প্রমাণিত হইয়াছে।”
ছাত্র-জনতার তুমুল গণ আন্দোলনের মুখে ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতে চলে যান। এরপর থেকে গ্রেপ্তার অভিযানের মধ্যে আগের সরকারের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীসহ দলের শীর্ষ নেতাদের অনেকে গ্রেপ্তার হয়েছেন। অন্যরা প্রকাশ্যে নেই বা বিদেশে চলে গেছেন। ছাত্রলীগের নেতাদেরও বেশির ভাগ সরকার পতনের পর আর সামনে আসেননি, তারাও পালিয়ে আছেন।আরও পড়ুন