দীর্ঘ ৭৫ বছর ধরে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছেন ফিলিস্তিনিরা। লম্বা এই সময়ে দখলদার ইসরাইলের সঙ্গে স্বাধীনতাকামী ফিলিস্তিনিদের বেশ কয়েকটি যুদ্ধ হয়েছে। কিন্তু অবরুদ্ধ ফিলিস্তিনিদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। তবে এবারের গাজা যুদ্ধে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলেও তা ভবিষ্যত ফিলিস্তিন তথা মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষমতা কাঠামোতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
গবেষণা বলছে, সর্বশেষ গাজা যুদ্ধ গোটা আরব বিশ্বে সম্মিলিত ক্ষোভ তৈরি করেছে। যাকে আরব নেতাদের জন্য ‘ওয়েক-আপ কল’ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
আরব সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি স্টাডিজ সম্প্রতি একটি জরিপ পরিচালনা করেছে। নতুন এই সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০১১ সালের পর যেকোনো সময়ের চেয়ে আরব বিশ্বে ফিলিস্তিনিদের প্রতি সমর্থন বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। ওই বছর থেকেই সংস্থাটি ইসরাইল-ফিলিস্তিন এবং অন্যান্য বিষয়ে আরব জনমতের ওপর পদ্ধতিগতভাবে জরিপ শুরু করে।
সর্বশেষ জরিপটি পরিচালিত হয় গত ১২ ডিসেম্বর থেকে ৫ জানুয়ারির মধ্যে। আরব সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি স্টাডিজ ১৬টি আরব দেশের ৮ হাজার মানুষের ওপর এই জরিপটি পরিচালনা করেছে। এতে আরব অঞ্চলের জনসংখ্যার ৯৫ শতাংশেরও বেশি প্রতিনিধিত্ব করে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ফিলিস্তিন ইস্যু, ৭ অক্টোবর ইসরাইলের অভ্যন্তরে হামাসের হামলা, গাজায় ইসরাইলের যুদ্ধ এবং মার্কিন নীতি-সহ বিভিন্ন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হয়।
গবেষণার ফলাফল বলছে, গাজার বিরুদ্ধে ইসরাইলের চলমান যুদ্ধ আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের অধীনে একটি গণহত্যা। এ কারণে ফিলিস্তিনিদের প্রতি আরব জনগণের সমর্থন যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে তেমনি প্রকট হয়েছে ইসরাইল ও আমেরিকা-বিরোধী মনোভাব।
জরিপে অংশ নেওয়া বিপুল সংখ্যক- অর্থাৎ ৯২ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, ফিলিস্তিন ইস্যু শুধু ফিলিস্তিনিদের বিষয় নয়, বরং সমস্ত আরব জনগোষ্ঠীর জন্য উদ্বেগের বিষয়। ফিলিস্তিনিদের প্রতি আরবদের এই সমর্থন ২০২২ সালে পরিচালিত জরিপের তুলনায় অনেক বেশি। ওই বছরের জরিপে ফিলিস্তিনিদের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিল ৭৬ শতাংশ আরব। তাছাড়া সর্বশেষ জরিপে ফিলিস্তিনিদের প্রতি যে সমর্থন জানানো হয়েছে, তা এখন পর্যন্ত রেকর্ড।
তাছাড়া এবারের সমীক্ষা অনুযায়ী, শুধু ফিলিস্তিনিদের প্রতি নয়, বরং হামাসের প্রতিও আরব জনসাধারণের সমর্থন জোরালো হয়েছে। ২০০৭ সাল থেকে গাজা উপত্যকা শাসন করে আসছে হামাস। কিন্তু ব্রিটেন ও অন্যান্য কিছু দেশ হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠনের তকমা দিয়েছে।
জরিপে বলা হয়েছে, আরব উত্তরদাতাদের প্রায় ৯০ শতাংশ বলেছেন, তারা হামাসের ৭ অক্টোবরের হামলাকে একটি ‘বৈধ প্রতিরোধ অভিযান’ মনে করেন। যদিও অভিযানে ‘কিছুটা ত্রুটি’ রয়েছে।
জরিপের ফলাফলের যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা হলো- ৮৯ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, তারা ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করেন। ইসরাইলকে স্বীকৃতি না দেওয়ার এই সংখ্যা আরব সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি স্টাডিজের জরিপের ইতিহাসে রেকর্ড। তবে জরিপে অংশগ্রহণকারী ১৩ শতাংশ আরব বলেছেন, তারা বিশ্বাস করেন- ইসরাইলের সঙ্গে শান্তি বজায় রাখা সম্ভব।
গাজা যুদ্ধের ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে আরবদের মতামত আরও নেতিবাচক হয়েছে। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৯০ শতাংশেরও বেশি বলেছেন, সাম্প্রতিক ঘটনাগুলিতে মার্কিন প্রতিক্রিয়া খুব খারাপ হয়েছে। আর ৭৬ শতাংশ বলেছেন, ৭ অক্টোবরের পর থেকে মার্কিন নীতি সম্পর্কে তাদের আরও নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়েছে।
আরব দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণে ইসরাইলের যে প্রচেষ্টা, তার প্রভাব এই ফলাফলের ওপর পড়েছে বলেও মনে করা হচ্ছে। ২০২০ সালে চারটি আরব দেশ- অর্থাৎ সংযুক্ত আরব আমিরাত, মরক্কো, সুদান এবং বাহরাইন ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চুক্তি করে।
এই চুক্তিগুলো অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ছিল, কারণ তারা ফিলিস্তিন ইস্যু এবং তাদের অঞ্চলগুলিতে ইসরাইলের অবৈধ দখলদারিত্ব নিয়ে উদ্বেগের বিষয়টিকে বাইপাস করেছিল। ইহুদিবাদীরা স্বাভাবিককরণের এই প্রচেষ্টার প্রশংসা করলেও, বিশেষজ্ঞ এবং প্যালেস্টাইনপন্থী গোষ্ঠীগুলো একে ফিলিস্তিন ইস্যুর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে দেখেন।
২০২০ সাল থেকে ৭ অক্টোবরের আগ পর্যন্ত ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ প্রচেষ্টায় যথেষ্ট গতি ছিল। এমনকি সৌদি আরব একটি চুক্তি করার পথে অনেকখানি অগ্রসর হয়েছে বলেও জোর প্রচারণা ছিল। কিন্তু গাজার বিরুদ্ধে ইসরাইলের সর্বশেষ যুদ্ধ এবং এর ফলে আরব বিশ্বে ইসরাইল সম্পর্কে যে নেতিবাচক অনুভূতি তৈরি হয়েছে, তা ভবিষ্যতে স্বাভাবিককরণ প্রচেষ্টাকে ব্যাহত করতে পারে- কিংবা অন্তত কার্যকর করাকে আরও কঠিন করে তুলতে পারে।
আরব সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি স্টাডিজের সর্বশেষ সমীক্ষা বলছে, সৌদি আরবের ৬৮ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন-তারা ইসরাইলকে স্বীকৃতির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন। এই সংখ্যা ২০২২ সালের চেয়ে দ্বিগুণ, কারণ ওই বছর মাত্র ৩৮ শতাংশ সৌদি নাগরিক ইসরাইলকে স্বীকৃতির বিষয়টিকে প্রত্যাখ্যান করেছিল।
অপরদিকে, ২০২২ সালের তুলনায় বর্তমানে ইসরাইলকে স্বীকৃতির বিষয়টি প্রত্যাখ্যানকারীর সংখ্যা বেড়েছে মরক্কো ও সুদানী আরবদের মধ্যেও। মরক্কোয় আগের ৬৭ শতাংশ থেকে বেড়ে এ সংখ্যা হয়েছে ৭৮ শতাংশ। অপরদিকে, বর্তমানে ৮১ শতাংশ সুদানিজ ইসরাইলের স্বীকৃতিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। ২০২২ সালে এ সংখ্যা ছিল ৭২ শতাংশ।
আরব সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি স্টাডিজ তাদের গবেষণায় বলছে, এই ফলাফল অর্থাৎ ইসরাইলের স্বীকৃতিকে প্রত্যাখ্যানকারীর সংখ্যার ব্যাপক বৃদ্ধি যে আরব শাসকদের সামনে ইহুদিবাদী রাষ্ট্রটির সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রচেষ্টাকে দুঃসাহসিক করে তুলেছে- তা স্পষ্ট।
আন্তর্জাতিক বিচার আদালত তথা আইসিসিতে ইসরাইলের বিরুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকা যে গণহত্যার মামলা করেছে, তাতে গত ৭ অক্টোবর থেকে ফিলিস্তিনে ইসরাইলের গণহত্যার বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। ইতোমধ্যে দখলদার ইসরাইলি বাহিনী ফিলিস্তিনে ৪৫ হাজারের বেশি নিরাপরাধ মানুষকে হত্যা করেছে, যার বেশির ভাগই নিষ্পাপ শিশু ও নারী।
এই অবস্থায় এমন একটি রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার রাজনৈতিক, নৈতিক এবং ধর্মীয় উপযুক্ততা সম্পর্কে আরব নাগরিকদের বোঝানো কঠিন হবে- বিশেষ করে যারা ফিলিস্তিনিদের দুর্দশার প্রতি অত্যধিক সহানুভূতিশীল। কারণ যে রাষ্ট্র বেসামরিক এলাকায় নির্বিচারে বোমা হামলা চালিয়েছে, হাসপাতাল, আশ্রয়কেন্দ্র এবং নিরাপদ রুটকেও পদ্ধতিগতভাবে হামলার লক্ষ্য বানিয়েছে- এমনকি নিরপরাধ বেসামরিক মানুষের কাছে মানবিক সাহায্য পৌঁছাতেও বাধা দেয়- তাদেরকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়কে সহজভাবে নেবে না আরব জনগোষ্ঠী।
এখন আরব শাসকদের সামনে যে একটি জটিল প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, তা হলো- তারা তাদের জনগণের কতটা অনুভূতি উপেক্ষা করতে ইচ্ছুক। কারণ নিজ দেশের নাগরিকদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ইসরাইলের সঙ্গে স্বাভাবিককরণের প্রক্রিয়ায় এগিয়ে যাওয়া যে ঝুঁকিপূর্ণ, সেটা বাস্তবে প্রমাণ হয়ে যেতে পারে।
প্রকৃতপক্ষে, আরব জনসাধারণের মাঝে ঐক্যবদ্ধ ক্রোধ সৃষ্টি হয়েছে। শেষবারের মতো এই ধরনের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল আরব বসন্তের যুগে, যখন গণতন্ত্রের দাবিতে আরবের রাস্তায় রাস্তায় ব্যাপক জনপ্রিয় বিক্ষোভ হয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো- আরব শাসকরা কি স্বাভাবিকীকরণ চুক্তিতে পাশা পাল্টাতে ইচ্ছুক হবে, যা অশান্তি সৃষ্টি করতে পারে? সেটা সময়ই বলে দেবে।
সম্ভবত যেকোনো কিছুর চেয়ে সাম্প্রতিক সমীক্ষার ফলাফল কিছু আরব শাসক এবং তাদের নাগরিকদের মধ্যে ব্যাপক সংযোগ বিচ্ছিন্নতার চিত্র প্রদর্শন করেছে।
বিরল ব্যতিক্রম ছাড়া বেশিরভাগ আরব সরকার ইসরাইলি নৃশংসতার জবাবে তুলনামূলকভাবে মৃদু ভাষায় তিরস্কার জানিয়েছে। এমনকি ইসরাইলের বিরুদ্ধে পদক্ষেপের অংশ হিসেবে তেল নিষেধাজ্ঞা আরোপের মতো জনপ্রিয় দাবিগুলোও আরব সরকারগুলির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেনি। উল্টো গুরুত্বপূর্ণভাবে পূর্বে সম্মত-স্বাভাবিককরণের চুক্তিগুলি অবিচ্ছিন্নভাবে অব্যাহত রয়েছে।
আরব সরকারগুলোর সঙ্গে তাদের জনগণের সংযোগ বিচ্ছিন্নতাকে সম্ভবত সবচেয়ে ভালোভাবে চিত্রিত করেছে মিশরের রাফাহ সীমান্ত ক্রসিং হ্যান্ডলিং। কারণ গাজায় ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় ঠেকাতে প্রয়োজনীয় ত্রাণ-সাহায্য প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হলেও রাফাহ ক্রসিং পুরোপুরি খুলে দেয়নি মিশর- যা একটি গুরুতর ব্যর্থতা হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
মাসের পর মাস ধরে মিশরীয় সরকার ত্রাণকর্মীদের কাজে বাধা দিয়ে আসছে এবং রাফা সীমান্ত সম্পর্কিত যেকোনো বিক্ষোভকে দমিয়ে রেখেছে। এমনকি ত্রাণ-সাহায্য সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত বিদেশি কর্মীদেরও গ্রেফতার করেছে মিশরীয় কর্তৃপক্ষ। অতি-সম্প্রতি একজন মিশরীয় নারী ফিলিস্তিনি পতাকা নেড়ে রাস্তায় শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের পাশাপাশি ন্যায়বিচারের দাবি জানিয়ে স্লোগান দিচ্ছিলেন, কিন্তু তাকে গ্রেফতার করে মিশর সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
এসব বিয়োগান্তক, দুঃখজনক, নিপীড়নমূলক সহিংসতার ঘটনা কখনও কখনও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের অনুঘটক হিসেবে কাজ করতে পারে। যেটা ঘটেছিল আরব বসন্তের সময়। তখন আরব শাসকদের সহিংসতার প্রতিবাদে অভূতপূর্ব জনবিক্ষোভ হয়েছিল। গণতন্ত্রের দাবিতে রাস্তায় রাস্তায় মানুষের গগনবিদারি স্লোগানে কেঁপে উঠেছিল আরব বিশ্ব। এটা সম্ভব, এবং সম্ভবত গাজায় গণহত্যা আরব রাজনীতিতে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সূচিত করতে পারে।
পরবর্তী রাউন্ডের জরিপের ফলাফল কী হবে- সেটা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারবে না। কিন্তু ইসরাইলি এবং মার্কিন আগ্রাসনকে ঠেকাতে যতক্ষণ পর্যন্ত আরব শাসকগোষ্ঠী অর্থপূর্ণ কোনো পদক্ষেপ না নিচ্ছে; এবং অধিকতর অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টির পাশাপাশি তাদের নাগরিকদের আকাঙ্ক্ষার সাথে সামঞ্জস্য রেখে তাদের নীতিগুলো সংশোধন না করবে- ততক্ষণ আরবের রাস্তায় ক্রোধ ও হতাশা বাড়তেই থাকবে।
আরব সরকারগুলো যদি তাদের জনগণের আহ্বানে সাড়া দেয়, তাহলে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেবে। আর তা না হলে- এটা বলা মুশকিল যে, জনগণের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ কখন কীভাবে ঘটবে।
লেখক: সাংবাদিক