২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক ঐতিহাসিক অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে। কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে উদ্ভূত ছাত্র-জনতার স্বতঃস্ফূর্ত গণঅভ্যুত্থান, সাধারণ মানুষের সরব অংশগ্রহণ এবং বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দীর্ঘ দেড় দশকের একক কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান ঘটে। এই আন্দোলন দেশে একটি গণতান্ত্রিক ও নির্বাচিত সরকারের স্বপ্ন জাগিয়েছিল। কিন্তু এক বছর পেরিয়ে এসে দেখা যাচ্ছে, যে ঐক্য গণঅভ্যুত্থানের পেছনে ছিল, তা এখন বিভাজিত। রাজনৈতিক মাঠে নতুন দ্বন্দ্বের আবহ তৈরি হয়েছে, যেখানে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর ভূমিকা ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আন্দোলনের মালিকানা নিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু হয়। আন্দোলনের ‘মাস্টারমাইন্ড’ কে, তা নিয়ে বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে বিতর্ক উঠে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত বছর জাতিসংঘের একটি অনুষ্ঠানে ছাত্রনেতা মাহফুজ আলমকে আন্দোলনের ‘মাস্টারমাইন্ড’ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন। এরপর থেকে আন্দোলনের নেতৃত্ব নিয়ে বিভিন্ন দল ও ব্যক্তির দাবি সামনে আসতে থাকে। জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের ছাত্র সংগঠন ছাত্রশিবির আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। আওয়ামী লীগের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার জামায়াত ও ছাত্রশিবিরের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলে তারা রাজনৈতিক মাঠে আরও উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। এমনকি, একসময় ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে পরিচিত কিছু ব্যক্তি পরবর্তী সময়ে ছাত্রশিবিরের পরিচয়ে আবির্ভূত হন, যা রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। অন্যদিকে, বিএনপি আন্দোলনের সময় কৌশলগতভাবে ‘নীরব’ থাকলেও পরবর্তী সময়ে তাদের রাজনৈতিক গুরুত্ব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আন্দোলনের সময় বিএনপি শিক্ষার্থীদের ‘নৈতিক সমর্থন’ দেওয়ার কথা বললেও তাদের সরাসরি সম্পৃক্ততা অস্বীকার করে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই কৌশলের কারণে আন্দোলনকে ‘ষড়যন্ত্র’ হিসেবে আখ্যায়িত করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয় আওয়ামী লীগ। পরবর্তী সময়ে বিএনপি নেতাকর্মীরা দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে আন্দোলনের ‘মূল নায়ক’ হিসেবে তুলে ধরেন। তবে তারেক রহমান বারবার বলে আসছেন, জুলাই আন্দোলন কোনো একক দল বা ব্যক্তির নয়, এটি সবার। এই বক্তব্য রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কাছে বিএনপির রাজনৈতিক বিচক্ষণতার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। অভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক মাঠে জামায়াত ও এনসিপির প্রভাব বাড়তে থাকে। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর এই দুই দল প্রশাসন থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে। তবে তাদের বিরুদ্ধে বিএনপিকে কোণঠাসা করার অভিযোগ উঠে। জামায়াত ও এনসিপি একই সুরে কথা বলে এবং বিএনপির বিরোধিতা করে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এই দুই দলকে একই মেরুতে অবস্থানকারী হিসেবে দেখছেন, এমনকি এনসিপিকে জামায়াতের ‘বি-টিম’ বা সরকারের মদদপুষ্ট ‘কিংস পার্টি’ হিসেবে আখ্যায়িত করছেন। এদিকে, বিএনপির জনসমর্থনের শক্তি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে ইশরাক হোসেনকে বুঝিয়ে না দেওয়ায় তিন সপ্তাহের বিক্ষোভ, তারুণ্যের সমাবেশে লাখো মানুষের সমাগম এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে ছাত্রদল ও বিএনপির বিজয় র্যালিতে বিপুল জনসমর্থন এটাই প্রমাণ করে যে বিএনপিকে জনবিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশের পরও রাজনৈতিক বিভাজন স্পষ্ট হয়। জামায়াত এই ঘোষণাপত্রকে ‘অপূর্ণাঙ্গ’ আখ্যা দিয়ে হতাশা প্রকাশ করে, যেখানে বিএনপি এটিকে স্বাগত জানায়। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ঘোষণা অনুযায়ী, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এই ঘোষণা বিএনপির দীর্ঘদিনের নির্বাচনের দাবিকে পুনরুজ্জীবিত করেছে। তবে জামায়াত ও এনসিপি এই ঘোষণার বিরোধিতা করে, নির্বাচনের আগে সংস্কার ও জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি নিশ্চিত করার দাবি তুলেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, জামায়াত ও এনসিপির নির্বাচনবিরোধী অবস্থানের পেছনে তাদের বর্তমান ক্ষমতার কাছাকাছি থাকার সুবিধা হারানোর আশঙ্কা কাজ করছে। এদিকে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে সুষ্ঠু নির্বাচন কঠিন হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরী বলেন, দ্রুত নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে, তবে আইনশৃঙ্খলার উন্নতি জরুরি। অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ মনে করেন, লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার ও পুলিশের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা না গেলে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। বর্তমানে বিএনপি দেশের সবচেয়ে বৃহৎ ও জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। জামায়াত ও এনসিপির প্রভাব থাকলেও বিএনপির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় তারা পিছিয়ে রয়েছে। আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে তাদের ভোটারদের অবস্থান নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে, রাজনৈতিক মাঠে বিভাজন ও ঐক্যের গতিপ্রকৃতি ততই স্পষ্ট হচ্ছে।