বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে তৎপর নির্বাচন কমিশন (ইসি)। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, নয়টি দেশে চলমান ভোটার নিবন্ধন কার্যক্রমে এরই মধ্যে ৪৯ হাজার ৫৭৪ জন প্রবাসী আবেদন করেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আবেদন এসেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে, ২০ হাজার ২০৯টি, আর সবচেয়ে কম অস্ট্রেলিয়া থেকে, মাত্র ২৫টি। ইসি জানিয়েছে, এই আবেদনগুলোর মধ্যে ২১ হাজার ৯৭১ জনের নিবন্ধন চূড়ান্ত হয়েছে, এবং তারা ইতোমধ্যে ভোটার হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছেন। নির্বাচন কমিশনের তথ্যমতে, ২৯ হাজার ৭৬৩ জন দশ আঙ্গুলের ছাপ প্রদানের মাধ্যমে নিবন্ধন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছেন। তবে তথ্যের ঘাটতি ও অন্যান্য কারণে ৩ হাজার ৯৩৭টি আবেদন বাতিল হয়েছে, যার মধ্যে আমিরাতের আবেদন বাতিলের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি, ২ হাজার ১৬৯টি। এদিকে, ১৮ হাজার ৩৪ জনের আবেদন সার্ভারে আপলোড সম্পন্ন হয়েছে, এবং আরও ৩ হাজার ৯৩৭ জনের আবেদন আপলোডের অপেক্ষায় রয়েছে। ইসি কর্মকর্তারা জানান, ৪০টি দেশে বাংলাদেশি প্রবাসীদের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি রয়েছে, যেখানে মোট প্রবাসী সংখ্যা ১ কোটি ৪০ লাখ ৪৬ হাজার ৫৩৪। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রবাসী রয়েছেন সৌদি আরবে, ৪০ লাখ ৪৯ হাজার ৫৮৮ জন, এবং সবচেয়ে কম নিউজিল্যান্ডে, ২ হাজার ৫০০ জন। বর্তমানে নয়টি দেশের ১৬টি স্টেশনে দূতাবাসের মাধ্যমে ভোটার নিবন্ধন কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে, যার মধ্যে রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, যুক্তরাজ্য, ইতালি, কুয়েত, কাতার, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডা। নতুন করে আরও ছয়টি দেশে এই কার্যক্রম শুরুর প্রস্তুতি চলছে। জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক এএসএম হুমায়ুন কবীর জানান, জাপান, ওমান, দক্ষিণ আফ্রিকা, জর্ডান, যুক্তরাষ্ট্র ও মালদ্বীপে ভোটার নিবন্ধনের জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি পাওয়া গেছে। জাপানে কার্যক্রম প্রায় চূড়ান্ত, তবে পাবলিক আইপি সংগ্রহে কিছুটা সময় লাগবে। ইসি প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়, জনশক্তি ব্যুরো, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রটিং এজেন্সি (বায়রা)-এর সহযোগিতায় এই কার্যক্রম পরিচালনা করছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার এএমএম নাসির উদ্দিন জানিয়েছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে ইসি কাজ করে যাচ্ছে। তিনি বলেন, “আমরা শুরু করতে চাই। সীমিত পরিসরে হলেও প্রবাসীদের ভোট দেওয়ার সুযোগ করে দিতে চাই। প্রথমে পাইলটিং, তারপর স্বল্প পরিসরে, এবং পরে বৃহৎ পরিসরে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।” ভোটার নিবন্ধনের পাশাপাশি ভোট প্রদানের পদ্ধতি নির্ধারণেও কাজ করছে ইসি। পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে প্রবাসীদের ভোট গ্রহণের পরিকল্পনা রয়েছে, যেখানে ব্যালটে শুধু প্রার্থীর প্রতীক থাকবে, নাম থাকবে না। ভোটাররা অনলাইনে নিবন্ধনের সময় প্রার্থীদের তালিকা দেখতে পাবেন এবং সেই অনুযায়ী তাদের পছন্দের প্রতীকে ভোট দিতে পারবেন। নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ জানান, সময় সাশ্রয়ের জন্য এই পদ্ধতি গ্রহণ করা হচ্ছে। তিনি বলেন, “কাছের দেশে ব্যালট পাঠাতে ১৮ দিন এবং দূরের দেশে ২৮ দিন সময় লাগে। তাই প্রার্থীর নামসহ ব্যালট পাঠানো সম্ভব নয়।” এই কার্যক্রম ব্যয়বহুল হলেও ইসি এটিকে গুরুত্ব দিচ্ছে। আবুল ফজল জানান, প্রতি ব্যালটে প্রায় ৫০০ টাকা এবং ছাপানোর খরচ আলাদা। এছাড়া নিবন্ধন কার্যক্রমের জন্য ৪৮ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নেওয়া হবে। প্রতি এক লাখ ভোটারের জন্য ৬ থেকে ৭ লাখ টাকা ব্যয় হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রবাসীদের ভোটার হতে চারটি তথ্য বাধ্যতামূলক: অনলাইনে পূরণকৃত আবেদনপত্র (ফরম-২(ক)), মেয়াদসম্পন্ন বাংলাদেশি পাসপোর্ট, অনলাইন জন্ম নিবন্ধন, এবং পাসপোর্ট সাইজের রঙিন ছবি। এছাড়া, চট্টগ্রাম অঞ্চলের ৫৬টি উপজেলা/থানার নাগরিকদের জন্য অতিরিক্ত কিছু তথ্য, যেমন শিক্ষা সনদ, পিতা-মাতার জাতীয় পরিচয়পত্র, ইউটিলিটি বিলের কপি ইত্যাদি জমা দিতে হবে। এই তথ্যগুলো সরাসরি নিবন্ধন কেন্দ্রে না দিতে পারলে দেশে থাকা আত্মীয়দের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট উপজেলা কর্মকর্তার কাছে জমা দেওয়া যাবে। ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনায় কেএম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন প্রবাসীদের জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র সরবরাহের উদ্যোগ নেয়। এর ধারাবাহিকতায় ২০১৯ সালের নভেম্বরে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মালয়েশিয়ায় এবং ২০২০ সালে যুক্তরাজ্যে এই কার্যক্রম শুরু হয়। তবে করোনা মহামারির কারণে কার্যক্রম কিছুটা ব্যাহত হয়। পরবর্তীতে ২০২২ সালে কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বে কার্যক্রম পুনরায় শুরু হয়, এবং বর্তমানে নাসির কমিশন তা আরও এগিয়ে নিচ্ছে। প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার এই উদ্যোগ বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থায় একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। ইসির এই প্রচেষ্টা সফল হলে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা বাংলাদেশিরা দেশের নির্বাচনে সরাসরি অংশগ্রহণের সুযোগ পাবেন, যা গণতন্ত্রকে আরও শক্তিশালী করবে।