আপন কেউ চলে গেলে বা মারা গেলে প্রাথমিকভাবে মেনে নিতে কষ্ট হয়।
আর এই অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে মানুষ এক ধরনের নিশ্চয়তা আশা করে- সিএনএন ডটকম’য়ে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এভাবেই মন্তব্য করেন মার্কিন মনোবিজ্ঞানী শেরি করমিয়ার।
তবে দুঃখ বোধের পাঁচটি স্তর রয়েছে। আর একেক স্তরের নিশ্চয়তার আশা করা হয় একেক রকমভাবে।
সুইস আমেরিকান মনোবিজ্ঞানী এবং মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের ওপর গবেষণার পথিকৃত এলিজাবেথ কিউবলার রস ১৯৬৯ সালে তার লেখা ‘অন ডেথ অ্যান্ড ডাইং’ বইতে দুঃখের এই পাঁচ স্তর সম্পর্কে উল্লেখ করেন।
এগুলো হল- ডিনায়ল বা অস্বীকার, অ্যাঙ্গার বা রাগ কিংবা ক্ষোভ, বার্গেইনিং বা দরকষা, ডিপ্রেশন বা বিষণ্নতা এবং অ্যাকসেপটেন্স বা মেনে নেওয়া।
“যদিও বইতে পাঁচেরও অধিক স্তর নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে তবে এগুলো মৌলিক”- একই প্রতিবেদনে মন্তব্য করেন ‘মৃত্যু ও শোক’-বিষয়ে মার্কিন বিশেষজ্ঞ ডেভিড কেসলার।
দুঃখের পাঁচ স্তর নিয়ে যদিও মতপার্থক্য রয়েছে। তবে কেসলার বলেন, “যারা দুঃখ কষ্টের মধ্যে থাকেন তাদের একটাই চাওয়া হয়, সেটা হল ‘আমাকে সাহায্য কর’।”
আর যে স্তরেই থাকা হোক না কেনো সেখান থেকে বের হয়ে আসার পন্থাও রয়েছে।
ডিনায়ল বা অস্বীকার
এই পর্যায়ে এক ধরনের কৃপা কাজ করে। কষ্টের সম্পূর্ণ অনুভূতি অনুভব করতে পারে না।
“শক এবং অবিশ্বাসের মাঝে কয়েকটি ক্ষণ বা দিন কেটে যায়, তারপর কষ্টটা বাড়তে থাকে বা ছড়িয়ে যায়”- বলেন কেসলার।
আক্ষরিক অর্থে অকার্যকর এই অনুভূতিতে নিজেকে বোঝাতে চায়, আপন যে চলে গেছে এটা ঠিক না।
কেসলার আরও বলেন, “দ্রুত দুঃখ-কষ্টের মাঝে পড়ার চাইতে, সাময়িকভাবে এই না বোঝার অনুভূতিটা এক দিক দিয়ে স্বাস্থ্যকর।”
এরকম বিপর্যস্থ অস্বীকারমূলক স্তরে বেশি মাত্রায় ভুগলে, নিজের মাঝে বাস্তবতা মেনে নেওয়ার দ্বন্দ্ব বন্ধ করার পরামর্শ দেন, করমিয়ার।
তার কথায়, “পরিস্থিতি উপলব্ধি করার জন্য সময় নিন, এটাই ভালো পন্থা।”
অ্যাঙ্গার বা রাগ কিংবা ক্ষোভ
হারানোর বেদনা প্রকাশের প্রাকৃতিক প্রতিক্রিয়া হল রাগ।
“রাগ হল কষ্টের রক্ষাকবজ বা দেহরক্ষী। এভাবেই আমরা কষ্টের অনুভূতি প্রকাশ করি। এই স্তরে স্বাস্থ্যকরভাবেই রাগ প্রকাশের সুযোগ দেওয়া হয়। মনে রাখতে হবে এটা মোটেই খারাপ না”- বলেন কেসলার।
আশাহীন অবস্থায় থাকা বা নিঃস্ব মনে হওয়ার অনুভূতি থেকে বের হয়ে আসতে প্রচণ্ড দুঃখের মাঝে মানুষ রাগ প্রকাশ করে। সেটা হতে পারে- আশপাশের পরিস্থিতির ওপর, কিংবা সৃষ্টিকর্তার ওপর বা কোনো মানুষের ওপর।
“আমাদের মন সবসময় হয় দোষী না হয় অসহায় বোধ করে। এই অনুভূতি থেকে বের হয়ে আসতে রাগ প্রকাশের প্রয়োজন হয়। না হলে হয়ত সারাক্ষণ আমরা নিজে দোষী ভেবে যাব”- বলেন কেসলার।
তিনি আরও বলেন, “পরিবারের সবাই একসময় মারা যাবে বা কেউ হয়ত চলে যাবে দূরে। তবে আমাদের মস্তিষ্ক সেটা মেনে নিতে চায় না।”
তাই সবসময় স্বাস্থ্যকর উপায়ে রাগ ঝাড়া জরুরি।
কেসলার পরামর্শ দেন, “হতে পারে সেটা মুখে বালিশ চেপে বা গাড়ির ভেতর একা রাগে চিৎকার করা, ‘পাঞ্চিং ব্যাগ’য়ে ঘুষি মারা বা দৌড়ানো।”
বার্গেইনিং বা দরকষা
কেসলার বলেন, “কাউকে হারানোর পর নিজেকে দোষীভাবা খুবই সাধারণ বিষয়। তখন ‘ইশ, যদি পারতাম’ এমন ভাবনা জেগে ওঠে। যেমন: মনে হতে থাকে- সে মারা যাবে জানলে আগে এটা করতাম বা করতাম না।”
“আমরা হয়ত কষ্টের সাথে দরকষা শুরু করি। যেভাবেই হোক কষ্ট বোধ যেন না হয়, সে চেষ্টা করতে থাকি। আর এই স্তর সপ্তাহ থেকে মাসখানেক স্থায়ী হতে পারে”- বলেন তিনি।
এক্ষেত্রে একটা কথাই মনে রাখতে হবে যে, সর্বোত্তম প্রচেষ্টার পরও এই পৃথিবীতে কোনো কোনো সময় বাজে ব্যাপার ঘটে যেতে পারে।
ডিপ্রেশন বা বিষণ্নতা
যখন কোনো কিছু হারানো অভিজ্ঞতা জীবনে গভীরভাবে প্রভাব ফেলে তখন বিষণ্নতা বা তীক্ষ্ণ দুঃখবোধ কাজ করে। মনে হয় এই কষ্ট আর শেষ হবে না। অথবা নিজেকে হয়ত গুটিয়ে একা হয়ে যেতে ইচ্ছে করে।
করমিয়ার বলেন, “বিভিন্ন সময়ে দুঃখবোধ মানুষকে আক্রান্ত করতে পারে। আমি একজনকে জানতাম, যিনি তার প্রিয় মানুষ হারানোর প্রথম বছর কোনো কষ্ট পাননি। তবে তৃতীয় বছর যেতে না যেতেই তিনি প্রচণ্ড দুঃখবোধের শিকার হন।”
এরকম হওয়ার কারণ হল, কেউ কেউ নিজেকে প্রবোধ দিয়ে রাখতে পারে, মানুষটা মারা যায়নি বা চলে যায়নি, আছে ছুটিতে, আবার ফিরে আসবে।
আর গভীর দুঃখবোধ জেগে ওঠার ক্ষেত্রে আসল উপলব্ধিটা হল- আসলেই আপন মানুষটা আর ফিরবে না, সেটা বোঝা।
করনিয়ার বলন, “তবে এই বিষণ্নতাকে সাধারণত অসুস্থতা হিসেবে ধরা হয়। যদি মনে হয় আপন মানুষের মৃত্যু বা চলে যাওয়ার ক্ষেত্রে গভীর কষ্ট হচ্ছে তবে মনোবিজ্ঞানীর সঙ্গে কথা বলে উপকার পাওয়া সম্ভব।”
আর দুঃখবোধ মানিয়ে নিতে নিজের প্রতি যত্ন নেওয়া আর বন্ধু বা পরিবারের সাহায্য নেওয়া যায়।
অ্যাকসেপটেন্স বা মেনে নেওয়া
“আপনজন চলে গেছে- বিষয়টা মেনে নেওয়া মানে এই নয় আপনি ঠিক হয়ে গেছেন। এর মানে হল বাস্তবতা মেনে নিয়ে নতুনভাবে জীবন শুরু করতে হবে”- মন্তব্য করেন করমিয়ার।
মেনে নেওয়া মানে দুঃখের শেষ নয়। হয়ত বিশেষ কোনো সময়, মুহূর্ত বা কোনো স্মরণীয় জায়গায় মৃত বা হারিয়ে যাওয়া আপন মানুষটার কথা মনে পড়ে যাবে।
কেসলার বলেন, “অনেকেই আমাকে জিজ্ঞেস করেন কতদিন দুঃখবোধ সইতে হবে? আমার উত্তর- যতদিন আপনি তাকে মৃত হিসেবে ভাবতে চান। কারণ একজন যতদিন ভেবে যাবেন তিনি নেই, ততদিন কষ্ট বোধ কমবে না।”
সবসময় দুঃখ-কষ্ট বোধ করার মানে নেই। দুঃখবোধের আসল লক্ষ্য হওয়া উচিত প্রিয় মানুষটাকে ভালোবাসায় স্মরণ করা, কষ্টে নয়।
“এই স্তরে আসার অর্থ হল, আপনি সেরে উঠছেন”- বলেন করমিয়ার।
তবে এই অবস্থায় আসতে সমস্যা হলে পেশাদার মনোবিজ্ঞানীর শরণাপন্ন হওয়া উচিত। অতি দুঃখবোধের কষ্ট স্বাভাবিক জীবনযাপন করাতে বাধা তৈরি করে, যাকে বলা হয় ‘প্রোলংড গ্রিফ ডিজঅর্ডার’।
আপন মানুষ মারা গেলে বা চলে গেলে এই ধরনের গভীর দুঃখবোধে এক বছর ধরে ভুগলে ধরে নিতে হবে ‘প্রোলংড গ্রিফ ডিজঅর্ডার’য়ে ভুগছেন তিনি।
করনিয়ার মনে করেন, “আমরা কেউ-ই দুঃখবোধ দূর করতে পারি না। তবে আমাদের মানিয়ে নেওয়ার পন্থা ভিন্ন হয়। প্রধান বিষয় হল- হারানোর বেদনা থেকে শিক্ষা নিতে হবে, যাতে আমরা নতুন বাস্তবতা নিয়ে সামনের দিকে আগাতে পারি।”