বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ১১:১৪ অপরাহ্ন

সেই মিরাজকে হারিয়ে দিশেহারা পরিবার,অল্প বয়সেই ধরেছিল সংসারের হাল

bornomalanews
  • Update Time : মঙ্গলবার, ১৫ অক্টোবর, ২০২৪
  • ২১ Time View

ইচ্ছে ছিল টাকা পয়সা রোজগার করে বাবাকে ভালো ডাক্তার দেখানো। ছোট ভাইদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করা। এই ইচ্ছে নিয়েই সীমান্তবর্তী জেলা লালমনিরহাট থেকে দেশের রাজধানী ঢাকায় ছুটে গিয়েছিলেন মিরাজ।

কিন্তু এই ইচ্ছে, এই স্বপ্ন মাটিতে বিলীন হয়ে গেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দেয়া মিরাজের। বলছি লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা ইউনিয়নের বারঘড়িয়া গ্রামের মিরাজুল ইসলাম মিরাজের(২১) কথা।

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট অন্যদের মতো যাত্রাবাড়ি থানার সামনের মাছের আড়ত এলাকায় আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন মিরাজ। সেই মিছিলে মিরাজের সঙ্গে ছিলেন তার খালাতো ভাই কারখানা শ্রমিক মাজেদুল ইসলাম (২৮)।

সেখানে তখন তীব্র মিছিল চলছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই পুলিশ অতর্কিতভাবে মিছিলে গুলি চালায়। আর সেই গুলিতেই মিরাজ ও তার খালাতো ভাই মাজেদুল গুলিবিদ্ধ হয়ে রাস্তায় গড়িয়ে পড়ে। এ অবস্থায় স্থানীয়রা তাদের উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে সুচিকিৎসা ও টাকা পয়সার অভাব দেখা দিলে তাদেরকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। পরে মিরাজের খালাতো ভাই মাজেদুল ইসলাম চিকিৎসা নিয়ে অনেকটাই সুস্থ হয়ে ওঠে। অন্যদিকে অস্ত্রোপচার করে মিরাজের শরীর থেকে গুলি বের করা হলেও শেষ পর্যন্ত তিনি আর বাঁচতে পারেননি ।

গত ৮ আগস্ট (বৃহস্পতিবার) সকাল ১০.৩০ মিনিটে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন স্বপ্নবাজ এই ছেলেটি । মিরাজ লালমনিরহাট জেলার আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা ইউনিয়নের বারঘড়িয়া এলাকার মোঃ আব্দুস সালাম (৪৫) ও মহসেনা বেগমের (৪০) বড় ছেলে। মেজবাউল ইসলাম (১৭) ও মোঃ সিরাজুল ইসলাম(১৪)নামে মিরাজের দু’জন ছোট ভাই রয়েছে। মেজবাউল নবম শ্রেণীতে ও সিরাজুল অষ্টম শ্রেণীতে পড়াশোনা করে। মিরাজের বাবা অসুস্থ।

মিরাজ মহিষখোচা বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি ২০২১ সালে এসএসসি পাশ করে পরিবার নিয়ে অর্থ উপার্জনের জন্য ঢাকার যাত্রাবাড়ি এলাকায় যান। সেখানে ভাড়া বাসায় থাকতো মিরাজের পরিবার। পরে মিরাজ ঢাকার দনিয়া মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে ভর্তি হন ।

পারিবারিক অস্বচ্ছলতার কারণে পড়াশুনার পাশাপাশি ঢাকার যাত্রাবাড়ি থানা এলাকার মাতুয়াইল রশিদবাগে স্থানীয় একটি মোবাইল রিচার্জ ও বিকাশের দোকানে তিনি কাজ নেন।

অসুস্থ বাবার চিকিৎসা আর ছোট দুই ভাইয়ের লেখাপড়াসহ পুরো সংসার চলতো মিরাজের আয়ে। বাবার চিকিৎসার জন্য ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা ঋণও করেছে মিরাজ ও তার বাবা। সংসারের হাল ধরতে লেখাপড়ার পাশাপাশি দোকানে কাজ করতেন মিরাজ। মিরাজকে গ্রামবাসী একজন নম্র, ভদ্র অথচ প্রতিবাদী যুবক হিসেবে বর্ণনা করেছে।

মিরাজের বাবা আব্দুস সালাম বলেন, ‘ছেলের মৃত্যুর পর আমাদের একেকটা দিন যেন একেকটা বছর।’

তিনি আরো বলেন, আমি একজন সিএনজি চালক ছিলাম। পরে ঘন ঘন অসুস্থ হওয়ার কারণে ডাক্তার দেখিয়েছিলাম। ডাক্তার প্রাথমিকভাবে ক্যান্সার হয়েছে বলে ধারণা করছেন। আরো পরীক্ষা নিরীক্ষা দরকার। এ জন্যে অনেক টাকা লাগবে। অথচ আমাদের একমাত্র উপার্জনক্ষম ছেলেটি আর নেই। তার মৃত্যুতে ভেঙ্গে পড়েছে আমার পুরো পরিবারের উপার্জনের চাকা।

আর্থিকভাবে সাহায্য পেয়েছেন কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে মিরাজের বাবা বলেন, হ্যাঁ,আর্থিকভাবে সাহায্য পেয়েছি। জেলা বিএনপির পক্ষ থেকে আমার পরিবারকে ১ লক্ষ টাকা দেওয়া হয়েছে। জামায়াতে ইসলামের পক্ষ থেকে ২ লক্ষ টাকা ও (নেভি) হেডকোয়ার্টার ঢাকা থেকে আরো ১ লক্ষ টাকা অনুদান দিয়েছে।

তিনি আরো বলেন, আমার ছেলেসহ দেশের এই আন্দোলনে যত মায়ের বুক খালি হয়েছে আর যারা এই খুনের সঙ্গে জড়িত আমি তাদের প্রত্যেককে বিচারের আওতায় দেখতে চাই। বর্তমান সরকারের প্রতি এ ব্যাপারে আমার অনুরোধ থাকলো।

মিরাজের মা মোহসেনা বেগম বলেন, আমার কলিজার টুকরা আর ফিরে আসবে না এটা ভেবেই দ’ুচোখের পাতা এক হয় না আমার।

তিনি আরো বলেন, সরকার যদি আমাদের সংসারের খোঁজ খবর রাখে এবং সাহায্য করে তাহলে আমাদের অসচ্ছল পরিবারটি হয়তো বা আবারো আগের মতো করে ঘুরে দাঁড়াবে। আমার স্বামীও হয়তো আবারও আগের মত সুস্থ হয়ে উঠবে।

মহিষখোচা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য আশরাফ আলী জানান, আমি নিজেই মিরাজের লাশ দেখেছি। তখন চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে বর্তমানে পরিবারটি পুরোপুরি নিঃস্ব।

মহিষখোচা বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মো: রবিউল ইসলাম জানান, মিরাজুল ইসলাম মিরাজ এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ছিল। তার ব্যবহার অনেক ভালো ছিল। প্রতিভাবান এই ছেলের হত্যার বিচার চাই আমরা।

লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এইচ এম রকিব হায়দার বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যেসব পরিবার ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে আমরা সরকারের পক্ষ থেকে তাদের সহযোগিতার সব রকম ব্যবস্থা করব।-বাসস

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
© All rights reserved © 2024 bornomalanews24.com
Design & Develop BY Coder Boss
themesba-lates1749691102