গত তিন বছরে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে যে নাটকীয় পরিবর্তন ঘটেছে, তার সর্বশেষ সংযোজন নেপাল। শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক বিপর্যয়, পাকিস্তানে ইমরান খানের পতন এবং বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনের পর এবার নেপালও গণবিক্ষোভের ঢেউয়ে ভেসে গেল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা জারির পর শুরু হওয়া আন্দোলন এখন রূপ নিয়েছে দুর্নীতিবিরোধী গণঅভ্যুত্থানে, যার ফলে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলি ও রাষ্ট্রপতি রামচন্দ্র পাওডেল2। বিক্ষোভের মাত্রা এতটাই ভয়াবহ যে রাজধানী কাঠমান্ডুতে ‘কেপি চোর, দেশ ছাড়’ স্লোগানে উত্তাল জনতা প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনসহ একাধিক সরকারি স্থাপনায় আগুন ধরিয়ে দেয়। হিলটন হোটেল, সাবেক প্রধানমন্ত্রীদের বাড়ি, এমনকি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবনও হামলার শিকার হয়। এখন পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ২২ জন3। নেপালের এই অস্থিরতা নতুন নয়। ২০০৮ সালে রাজতন্ত্র বিলুপ্তির পর থেকে দেশটিতে ১৭ বছরে ১৪টি সরকার পরিবর্তন হয়েছে, যার বেশিরভাগই ছিল জোট সরকার। দুর্নীতি, অর্থনৈতিক স্থবিরতা ও বেকারত্বে জর্জরিত তরুণ প্রজন্ম ‘নেপো কিড’ আন্দোলনের মাধ্যমে রাজনৈতিক অভিজাতদের বিলাসী জীবনধারার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। অলি সরকারের চীনের প্রতি ঝুঁকে পড়া এবং ভারতকে উপেক্ষা করে প্রথম সফরে বেইজিং যাওয়া জনমনে ক্ষোভ বাড়িয়ে তোলে। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে যোগ দিয়ে নেপাল ৪১ মিলিয়ন ডলার সহায়তা পেলেও, এর বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রও সক্রিয় হয়ে ওঠে। ট্রাম্প প্রশাসন নেপালকে ৫০০ মিলিয়ন ডলারের ‘মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ কমপ্যাক্ট’ প্রকল্পে ফিরিয়ে আনে, যা চীন-যুক্তরাষ্ট্র ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্বকে আরও তীব্র করে তোলে। বিশ্লেষক এসএল কান্তনের মতে, “এটি শতভাগ মার্কিন প্রভাবিত বিপ্লব”। বাংলাদেশে শেখ হাসিনার পতনের মতো নেপালেও যুক্তরাষ্ট্রের ছায়া দেখা যাচ্ছে বলে অনেকে মনে করছেন। এই অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি ও বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার ছায়ায় নেপাল এখন এক নতুন ভূরাজনৈতিক যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। প্রশ্ন উঠছে—এই উত্তাল তরঙ্গ কি দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিকে আরও অস্থির করে তুলবে, নাকি এটি হবে একটি নতুন রাজনৈতিক জাগরণের সূচনা?