দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে হাইব্রিড রিজিম দেশে যে স্বৈরাচারী শাসন-শোষণ ও অর্থনৈতিক লুটপাট চালিয়েছিল তার নেপথ্যের মূল শক্তি ও সুবিধাভোগী ছিল ভারত। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্টে পতনের পর হাসিনাকে আশ্রয় দিয়ে ভারতীয়রা এটাই প্রমান করেছে, তাদের কাছে বাংলাদেশের জনগণ নয়, স্বৈরাচারী হাসিনাকে রক্ষা করা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে এক মুহূর্তের জন্যও বসে নেই। দেশে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বেশিরভাগ আত্মগোপনে থাকলেও নানা ছদ্মবেশে তারা অর্ন্তবর্তী সরকারকে অস্থিতিশীল ও ব্যর্থ করতে একের পর এক ষড়যন্ত্র করেই চলেছে। ঢাকায় আনসারদের জড়ো করে সচিবালয় দখলে নিয়ে সরকারের পতন ঘটানোর একটি বড় ষড়যন্ত্র ছাত্র-জনতার প্রতিরোধে ব্যর্থ হওয়ার পর এবার গার্মেন্ট শ্রমিকদের নিয়ে নতুন ষড়যন্ত্রে মেতে উঠতে দেখা যাচ্ছে। ভারতীয় এজেন্টরা অতীতে বাংলাদেশের পাটশিল্প ধ্বংসে কুশীলবের ভ’মিকা পালন করেছিল। ধারাবাহিক শ্রমিক বিক্ষোভ, অগ্নিকান্ড ও নাশকতার মধ্য দিয়ে দেশের পাটকলগুলো দেউলিয়া হয়ে বাংলাদেশের পাটের বিশ্ববাজার ভারতের দখলে চলে গিয়েছিল। বাংলাদেশে যখন একের পর এক পাটকলগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল, কলকাতার আশপাশে হুগলি নদীর ধারে তখন নতুন নতুন পাটকল গড়ে উঠেছিল। ভারতের বশংবদ হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশের অর্থনীতি ও রফতানি বাণিজ্যে সবচেয়ে বড় অবদান রাখা গার্মেন্ট সেক্টরকে অস্থিতিশীল করে তা পাটশিল্পের পরিনতির দিকে নিয়ে যাওয়ার ষড়যন্ত্র সক্রিয় রয়েছে। শ্রমিক বিক্ষোভের কারণে সাভার-আশুলিয়ায় এখনো শতাধিক গার্মেন্ট কারখানা বন্ধ রয়েছে। সে সব শ্রমিক বিক্ষোভে শ্রমিকদের চেয়ে বহিরাগতদের অংশগ্রহণ বেশি বলে গার্মেন্ট শিল্প মালিকদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। সাধারণ মানুষের ছদ্মবেশে স্থানীয় আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ নেতাদের এসব আন্দোলনে উস্কানি দিতে দেখা গেছে। বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএ’র পক্ষ থেকে পোশাক শিল্পে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির মাধ্যমে বাজার ধ্বংসের আশংকার কথা বলা হচ্ছে। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, শ্রমিক অসন্তোষ নিরসন ও গার্মেন্ট শিল্পের নিরাপত্তায় সেনাবাহিনী চেষ্টা করলেও কেন তা ফলপ্রসু হচ্ছে না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।বাংলাদেশে গার্মেন্ট কারখানা বন্ধ হলে, ক্রয়াদেশ ও বাজার হারালে ভারতের গার্মেন্ট সেক্টরের লাভ, এই সহজ সমীকরণ কেউ না বুঝার কথা নয়।দেশের গার্মেন্ট ব্যবসায়ীদের সংগঠন বিজিএমইএ’র নির্বাচিত নেতারা গত দেড় দশক ধরে স্বৈরাচারি সরকারের অগণতান্ত্রিক শাসনের অন্যতম সহযোগি হিসেবে কাজ করেছেন। হাসিনার পতনের পর তাদের মধ্যে নেতৃত্বের কিছু পরিবর্তন ঘটলেও তাদের ভ’মিকা এখনো অস্বচ্ছ এবং বিতর্কিত। গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত বিপ্লবী সরকারের প্রতি দেশের মানুষের নিরঙ্কুশ সমর্থন রয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। এ দেশের মুক্তিকামী ছাত্র-জনতা ড. ইউনূসের মত একজন বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিকে অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে পেয়েছে, এটা তাদের জন্য অনেক বড় সুযোগ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীনসহ উন্নয়ন সহযোগিরা ড.ইউনূসের সাথে বাংলাদেশের উন্নয়নে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। অন্যদিকে ভারত মুখে যা’ই বলুক, এখনো তার নেপথ্য ভূমিকা হতাশাজনক। বাংলাদেশে গণতন্ত্র না থাকা এবং স্বৈরাচার হাসিনাকে দেড় দশক ধরে টিকিয়ে রাখার পেছনে ভারতের একচেটিয়া অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক স্বার্থ ছিল। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শুধু স্বৈরাচার শেখ হাসিনারই পতন হয়নি, সেই সাথে এদেশে ভারতীয় আধিপত্যেরও পতন ঘটেছে। অর্ন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ভারতের সাথে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ভিত্তি হিসেবে সমতা ও ন্যায্যতার কথা বলেছেন। ভারতীয়রা সে দিকে কর্ণপাত না করে হুমকি ও ষড়যন্ত্রের পথ বেছে নিয়েছে বলে নানা কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে দেশের ছাত্র-জনতা সজাগ ও সচেতন থাকলেও ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের একটি অংশ এবং শ্রমিকের ছদ্মবেশে আওয়ামীলীগ-ছাত্রলীগ-যুবলীগের কর্মীরা গার্মেন্ট সেক্টরকে অস্থিতিশীল করার চক্রান্তে লিপ্ত রয়েছে। ইতিপূর্বে ব্যবসায়ীদের একটি প্রতিনিধিদলকে প্রধান উপদেষ্টার পাশাপাশি সেনাপ্রধানের সাথেও সাক্ষাৎ করতে দেখা গেছে। এমনিতেই কিছু যৌক্তিক কারণে সেনাপ্রধানের ব্যাপারে প্রশ্ন উঠেছে। ব্যবসায়ীরা ড.ইউনূস ছাড়াও সেনাপ্রধানের সাথে আলাদা বৈঠক করায় এটা মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, তারা সেনাবাপ্রধানকে ঘিরে একটা আলাদা বা স্বতন্ত্র প্রভাব বলয় সৃষ্টি করতে চেয়েছে। কোনো দেশের ক্ষমতাকেন্দ্র একাধিক হতে পারে না। ড. ইউনূসের সরকারই রাষ্ট্রক্ষমতায় পূর্ণ কর্তৃত্বশীল। ছাত্র-জনতা জীবনের বিনিময়ে বিপ্লবের মধ্য দিয়ে এ ক্ষমতা তাঁকে দিয়েছেন। ইউনূস সরকারকে আন্ডারমাইন করার কোনো সুযোগ নেই। ব্যবসায়ী বা যে কোনো পক্ষের এ ধরণের প্রবণতা ও প্রয়াস রাষ্ট্র ও সরকারের জন্য বিপজ্জনক।এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বিগত দেড় দশকে দেশ থেকে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা পাচারের পেছনে এক শ্রেণীর গার্মেন্ট মালিক ও দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীর প্রত্যক্ষ ভ’মিকা ছিল। অর্থপাচার বন্ধ করার পাশাপাশি পাচারকৃত অর্থ দেশে ফেরত আনা বর্তমান সরকারের অন্যতম লক্ষ্য ও চ্যালেঞ্জ। দেশের পুলিশ বাহিনী এখনো অনেকটাই নিস্ক্রিয়। এমতাবস্থায় সামাজিক-অর্থনৈতিকভাবে দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে ইউনূস সরকারের প্রতি সেনাবাহিনীল পূর্ণ সমর্থন থাকতে হবে। বিশেষত সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের সামগ্রিক কর্মকান্ড, দায়িত্ব ও চেইন অব কমান্ড প্রতিপালনে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সেনাবাহিনী সিভিল প্রশাসনের সহযোগিতায় কাজ করে থাকে। সেখানে ক্ষমতার ভারসাম্য কিংবা বিকল্প ভরকেন্দ্রের কোনো সুযোগ নেই। পতিত স্বৈরাচারের দোসর ও নানা ঘৃণ্য অপকর্মের সহযোগী হিসেবে যে সেনা কর্মকর্তারা দেড় দশক ধরে মানবতা বিরোধী অপরাধে জড়িত ছিল, তাদেরকে আইনের আওতায় এনে বিচার নিশ্চিত করতে অর্ন্তবর্তী সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সেনাপ্রধানের আন্তরিক প্রচেষ্টা ও সেনাবাহিনীর সক্রিয় সমর্থন ও অংশগ্রহণ এ ক্ষেত্রে অত্যাবশ্যক। পতিত স্বৈরাচারের দোসর সাবেক মন্ত্রী, আমলা, পুলিশ ও সেনাকর্মকর্তারা ওয়ারেন্টভুক্ত ব্যক্তি। তারা কিভাবে নিরাপত্তার নামে সেনানিবাসে আশ্রয় পেয়েছে এবং সরকারের সংশ্লিষ্টদের অগোচরে অবাধে দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে, তা নিয়ে সিটিজেন ও নেটিজেনদের মধ্যে নানা প্রশ্ন ও সন্দেহের জন্ম দিয়েছে। ইউনূস সরকারের প্রতি মানুষের অকুণ্ঠ আস্থা ও অনেক প্রত্যাশা রয়েছে। ছাত্র-জনতা ও সেনাবাহিনীর সমন্বিত সহযোগিতা পেলে এই সরকার জনগণের গণতান্ত্রিক প্রত্যাশার বাস্তবায়ন ঘটাতে সক্ষম হবে। দীর্ঘ দেড় দশকের আন্দোলন-সংগ্রামের শেষ প্রান্তে অভূতপূর্ব এক রক্তাক্ত অভ্যুত্থানে হাজার হাজার ছাত্র-জনতার প্রাণের বিনিময়ে বাংলাদেশের মানুষ এক নতুন স্বাধীনতা অর্জন করেছে। ড.ইউনূসের মত প্রাজ্ঞ ও বিশ্ববরেণ্য নেতা দ্বিতীয় স্বাধীনতার লক্ষ্য বাস্তবায়নের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন। কিন্তু পতিত স্বৈরাচারের এজেন্ট ও সুবিধাভোগীরা বসে নেই, সেনানিবাস থেকে সচিবালয় এবং শিল্পাঞ্চলে তারা সক্রিয় রয়েছে। জিরো টলারেন্স নীতির মাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নে সরকারের সাথে সেনাবাহিনীসহ সব অংশীজনকে দায়িত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।