নাফিসা হোসেন মারওয়ার বাবা আবুল হোসেন সামান্য চা দোকানি। মেয়ের পড়াশোনার খরচ জোগাতে উদয়াস্ত পরিশ্রম করেন। স্বপ্ন দেখতেন, মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে। মারওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির যোগ্যতা অর্জন করেছেন। গতকাল মঙ্গলবার প্রকাশিত এইচএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ ৪ দশমিক ২৫ পেয়েছেন। মেয়ের ফলে আবুল হোসেনের খুশি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পিতার বুকে বেদনা ভর করেছে। কারণ মারওয়া তো নেই। প্রাণ দিয়েছেন ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে।
জীর্ণ জাতির বুকে আশা, মৌন-মলিন মুখে ভাষা জোগাতে লেখাপড়া ফেলে অভ্যুত্থানে লাখ লাখ শিক্ষার্থী নেমেছিলেন রাজপথে। এক নদী রক্তে কর্তৃত্ববাদী শাসনের বন্দিশালার শিকল ভাঙা এ অভ্যুত্থানকারীদের মধ্যে হাজার হাজার ছিল এইচএসসি কিংবা আলিম পরীক্ষার্থী, যারা পরীক্ষার মাঝপথে আন্দোলনে যোগ দেন। তাদের মধ্যে অন্তত ১৫ পরীক্ষার্থী প্রাণ দিয়েছেন।
সমকাল যে ১২ জনের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছে, তাদের ১০ জন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। এ সাফল্য কাঁদাচ্ছে সবাইকে। জিপিএ ৫ পাওয়া ঠাকুরগাঁওয়ের আবু রায়হানের ফল শুধু পরিবারকে নয়; এক মেধাবীকে হারানোর বেদনায় সিক্ত করেছে গোটা দেশকে।
গত ১৯ জুলাই যাত্রাবাড়ীর কাজলায় পুলিশের গুলিতে নিহত হন সরকারি তোলারাম কলেজের ব্যবসায় শিক্ষা শাখার এইচএসসি পরীক্ষার্থী মাহাদী হাসান পান্থ। তিনি ৩ দশমিক ১৭ পেয়েছেন। ১৮ বছর বয়সী এ তরুণ সাতটি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন।
গতকাল পান্থের বড় ভাই মেরাজ উদ্দিন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তালিকায় পান্থের নাম অন্তর্ভুক্ত না হওয়ায় আক্ষেপ প্রকাশ করেন। তিনি সমকালকে বলেন, পান্থ ৩ দশমিক ১৭ পেয়েছে। এখন এগুলো বলার ভাষা নেই। এখন পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে কেউ আসেনি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনেরও কেউ আসেনি। তবে নাগরিক কমিটি অনুষ্ঠান করছিল; সেখানে গিয়েছিলাম।
টঙ্গী (গাজীপুর) প্রতিনিধি জানিয়েছেন, ৫ আগস্ট সাভারে গুলিতে নিহত হন টঙ্গীর এরশাদনগরের মারওয়া। ১৭ বছর বয়সী এ কিশোরী বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আহ্সান উল্লাহ্ মাস্টার স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেছেন। গতকাল কলেজে গিয়ে দেখা যায়, উত্তীর্ণরা পরীক্ষার ফলে উল্লাস করছেন নাফিসা মারওয়ার হয়ে।
আবুল হোসেন বলেন, দুই বছর ধরে তার মা কুয়েত প্রবাসী। মেয়ের যাতে লেখাপড়া নষ্ট না হয়, সে জন্য রান্না করতে দিতাম না। সেই মেয়েটা আমার থাকল না! রেজাল্ট দিয়ে কী করব?
শেরপুর প্রতিনিধি জানিয়েছেন, গত ৪ আগস্ট শ্রীবরদী উপজেলার আইডিয়াল প্রিপারেটরি অ্যান্ড হাই স্কুল এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন ১৭ বছর বয়সী সবুজ মিয়া। শ্রীবরদী সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় মানবিক বিভাগ থেকে সবুজ ৪ দশমিক ৩৩ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন।
স্থানীয়রা জানান, সবুজের পরিবার খুবই গরিব। ঢাকায় কাজ করে তিনি জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে উত্তীর্ণ হন। কলেজে পড়ার সময় শ্রীবরদী লঙ্গরপাড়া বাজারে ওষুধের দোকানে কাজ করতেন। এতে সংসার ও লেখাপড়ার খরচ চলত।
সবুজের মা সমেজা বেগম আহাজারি করে জানান, ছেলে তাঁর অনেক কষ্টে লেখাপড়া করেছে। জীবনটা কষ্টে কষ্টে শেষ হলো। পাসে আর কী হবে!
ঈশ্বরগঞ্জ (ময়মনসিংহ) সংবাদদাতা জানিয়েছেন, বক্সার হওয়ার স্বপ্ন ছিল অভ্যুত্থানে প্রাণ দেওয়া শেখ শাহরিয়ার বিন মতিনের। সেজন্যই এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিতের পর ঢাকায় এসেছিলেন ১৮ বছর বয়সী এ তরুণ। কিন্তু শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের হত্যাযজ্ঞের বর্বরতা দেখে প্রতিবাদে জড়িয়ে যান। ১৯ জুলাই বিকেলে মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বরে মিছিলে গুলিবিদ্ধ হন। ডান চোখের পাশ দিয়ে গুলি ঢুকে মস্তিষ্ক ছেদ করে যায়।
শাহরিয়ারের বাড়ি ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জের কুমড়াশাসন উত্তরপাড়া গ্রামে। পৌর এলাকার আইডিয়াল থেকে মানবিক বিভাগের জিপিএ ৪ দশমিক ৮৩ পেয়েছেন। তাঁর বাবা মোহাম্মদ আবদুল মতিন তা ফেসবুকে জানিয়েছেন। তিনি সস্ত্রীক ওমরাহ পালনে সৌদি আরব আছেন।
শাহরিয়ারের মামাতো ভাই সোহানুর রহমান রিয়াদ সমকালকে জানান, ছেলের ফল ফোন করে বাবা-মাকে জানানো হলে তারা কান্নায় ভেঙে পড়েন।
বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, শাহরিয়ারের পরীক্ষার ফলের খবরে পাড়া-প্রতিবেশীরাও এসে জড়ো হয়েছেন। নাতির কথা স্মরণ করে বারান্দায় বসে বিলাপ করছেন শাহরিয়ারের অশীতিপর দাদি। প্রতিবেশীরা অনেকেই সান্ত্বনা দিচ্ছেন তাঁকে।
শাহরিয়ার যে কক্ষে ঘুমাতেন, চেয়ার-টেবিলে বসে পড়াশোনা করতেন, সবকিছুই অগোছালো পড়ে আছে। কলেজের ব্যাগগুলোও ধুলা জমে পড়ে আছে টেবিলের এক কোনায়। রিয়াদ বলেন, ‘রেজাল্টটা প্রথমে আমি তুলেছি। পরে দৌড়ে গেছি ভাইয়ের কবরের পাশে। গিয়ে বলছি, উঠ ভাই, দেখ তোর রেজাল্ট বের হইছে। তুই কত ভালো রেজাল্ট করছস। সবাইকে মিষ্টি খাওয়াতে হবে না? উঠ ভাই, উঠ। কিন্তু আমার ভাই উঠল না।’
ঈশ্বরগঞ্জ আইডিয়াল কলেজের অধ্যক্ষ আলমগীর কবীর সমকালকে বলেন, শাহরিয়ার পড়াশোনায় যেমন মেধাবী, আচার-আচরণেও অসম্ভব বিনয়ী ছিল। একটি রত্ন হারিয়েছি আমরা।
লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি জানিয়েছেন, অভ্যুত্থানে গুলিতে নিহত সাদ আল আফনান পাটওয়ারী ভিক্টোরিয়া কলেজের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ ৪ দশমিক ১৭ পেয়েছেন। তাঁর মা নাছিমা আক্তার কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, গুলি করে আমার ছেলেকে মেরে ফেলেছে। আমার কোল শূন্য করে দিয়েছে। তাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল। এইচএসসি পাসের পর বিদেশে পড়তে যাওয়ার কথা ছিল।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের লক্ষ্মীপুরের সমন্বয়ক এনামুল হক বলেন, আফনান লক্ষ্মীপুরের প্রথম শহীদ।
৪ আগস্ট লক্ষ্মীপুরের মাদাম ব্রিজ এলাকায় সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান এবং লক্ষ্মীপুর জেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি এ কে এম সালাউদ্দিন টিপুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা গুলি চালায় ছাত্র-জনতার মিছিলে। প্রাণ হারান আফনান।
নোয়াখালী প্রতিনিধি জানিয়েছেন, ঢাকার গুলশান কমার্স কলেজ থেকে জিপিএ ২ দশমিক ৯২ পেয়েছেন শহীদ রায়হান আহম্মেদ। তাঁর গ্রামের বাড়ি নোয়াখালী সদরের নোয়ান্নই ইউনিয়নের পূর্ব দুর্গানগর গ্রামে।
গত ৫ আগস্ট রাজধানীর বাড্ডায় এলাকায় ছাত্র-জনতার মিছিলে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন রায়হান। তাঁর বাবা মোজাম্মেল হোসেন বলেন, একমাত্র ছেলে আমার। অনেক স্বপ্ন ছিল। আমার আর বাঁচার স্বাদ নেই।
রায়হানের মা আমেনা বেগম কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘ছেলেই দুনিয়ায় নাই। তার পাস দিয়ে এখন কী করব? তার আরও ভালো ফল করার কথা ছিল। এত কষ্টের মধ্যে ছেলেকে ঢাকায় রেখে পড়াশোনা করিয়েছি। এক গুলিতেই ছেলের দুনিয়া শেষ করে দিল।’
পটুয়াখালী প্রতিনিধি জানিয়েছেন, সাগর গাজী পটুয়াখালীর গলাচিপার উলানিয়া হাট মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজ থেকে মানবিক বিভাগ থেকে ৩ দশমিক ৯২ পেয়ে পাস করেছেন। ছেলের ফলাফলের খবরে কান্নায় ভেঙে পড়েন সাগরের বাবা-মা। বিলাপ করে তাঁর মা শাহিদা বেগম বলেন, ‘আইজ আমার সাগর বেঁচে থাকলে অনেক খুশি হইতো, আমিও খুশি হইতাম। আইজ পরীক্ষার রেজাল্ট দেখে খুশিতে বন্ধুবান্ধবদের লইয়া ঘুরতে যেত, আমাকেও আনন্দ দিত।’ বাবা সিরাজুল ইসলাম গাজী বলেন, ‘ছেলেটা পরীক্ষায় পাস করায় বুকের কষ্ট আরও বেড়েছে।’
পরীক্ষা স্থগিত হওয়ায় সাগর গাজী ঢাকায় এসেছিলেন চাচার বাসায়। যোগ দেন আন্দোলনে। ৫ আগস্ট বিজয় মিছিলে যোগ দিয়ে উত্তরায় গুলিতে নিহত হন। এর আগের দিন তিনি ফেসবুকে লিখেছিলেন, ‘আজ যদি আমি মারা যাই, মা কবরের পাশে পতাকা দিও। হয়তো লাশ হব, নয়তো ইতিহাস হব।’
যশোর অফিস জানায়, যশোর সরকারি সিটি কলেজের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে শাওয়ান্ত মেহতাপ প্রিয় জিপিএ ৪ দশমিক ১ পেয়ে পাস করেছেন। ৫ আগস্ট নিহত হন এ শিক্ষার্থী। তাঁর মা রেহেনা পারভীন সমকালকে বলেছেন, ‘আমার ছেলে যে কত ভালো। বাবা-মা ছাড়া তার জীবনে কিছু ছিল না। মনে হয়, এখনই আমার কাছে ফিরে আসবে। বলবে, দেখ মা আমি পাস করেছি। তোমার দোয়া কাজে লেগেছে।’
দেবিদ্বার (কুমিল্লা) প্রতিনিধি জানান, ঢাকার দক্ষিণখান এসএম মোজাম্মেল হক টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে ফয়সাল সরকার জিপিএ ৪ দশমিক ৩৫ পেয়েছেন। তাঁর দুলাভাই আবদুর রহিম এ তথ্য জানিয়েছেন। তিনি জানান, ফয়সাল সংসারের অভাব ঘুচাতে লেখাপড়ার পাশাপাশি শ্যামলী পরিবহনের একটি বাসে সুপারভাইজার ছিল। ১৯ জুলাই আবদুল্লাহপুরের নিহত হয়। কিন্তু মরদেহ পাওয়া যায় ১২ দিন পর। ফয়সালকে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়েছে। কবর কোনটি পরিবার আজও জানে না।
রসায়ন, গণিত ও জীববিজ্ঞানে এ প্লাস পেয়েও ফেল রোহান!
যাত্রাবাড়ীতে ১৯ জুলাই পান্থের সঙ্গে গুলিবিদ্ধ হয়ে জীবন দেন দনিয়া কলেজের বিজ্ঞান শাখার এইচএসসি পরীক্ষার্থী রোহান আহমেদ খান। প্রকাশিত ফলাফলে রোহান রসায়ন, উচ্চতর গণিত, জীববিজ্ঞানে এ প্লাস, ইংরেজি ও বাংলায় বি, আইসিটিতে এ পেয়েছেন। তবে পদার্থবিজ্ঞানে ফেল করেছেন।
রোহানের বড় ভাই রাহাত আহমেদ খান সমকালকে বলেন, পদার্থবিজ্ঞান পরীক্ষা দিয়ে এসে রোহান বলেছিল, পরীক্ষার হলে সমস্যা হয়েছে। তাঁর খাতা আটকে রাখা হয়েছে, তেমন কিছু উত্তর করতে পারেনি। এখন আর কিছু অবশিষ্ট নেই।
রাহাত আহমেদ বলেন, সরকারের কাছে এতটুকুই চাওয়া, রোহানকে শহীদের মর্যাদা দেওয়া এবং অপরাধী ও তার দোসরদের দ্রুত বিচার। আমার ভাইয়ের শরীরে দুটি গুলি লেগে শরীর ভেদ করে গেছে। এত নৃশংস কাজ করেছে তারা। কারা অর্ডার করেছে, কারা গুলি করেছে সবই তো চিহ্নিত। বিচারের কাজটা আরও দ্রুত, আরও কার্যকরভাবে করা হোক। কারণ এখনও হামলায় জড়িতরা ঘুরে বেড়াচ্ছে।