রিপোর্ট: দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্পে সম্প্রতি একের পর এক কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, যা অর্থনীতির ওপর গভীর চাপ সৃষ্টি করেছে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রভাব, ঋণের বোঝা, বৈদেশিক ক্রেতার কার্যাদেশ সংকট এবং শ্রমিক অসন্তোষ—বিভিন্ন কারণে এই খাতের টালমাটাল অবস্থা এখন সকলের নজরে। এর ফলে রাস্তায় নেমে আসতে বাধ্য হচ্ছেন হাজার হাজার শ্রমিক, বাড়ছে বেকারত্ব। শুধু পোশাক খাতেই নয়, দেশের অন্যান্য উৎপাদন খাতেও একই সংকট দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। কারখানা বন্ধ হওয়া ও কর্মসংস্থান কমে যাওয়া দেশের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলে উদ্বেগ বাড়িয়েছে। যদিও একই সময়ে কিছু নতুন কারখানা চালুর ঘটনা আশার সঞ্চার করলেও, সেটি সামগ্রিক সংকট কাটানোর জন্য যথেষ্ট নয় বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও শিল্প সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা, শ্রমিকদের স্বার্থ সংরক্ষণ এবং আন্তর্জাতিক বাজারে টিকে থাকতে কৌশলগত পুনর্গঠন এখন সময়ের দাবি। অন্যথায়, বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাত বড় ধাক্কা খেতে পারে, পাশাপাশি অন্যান্য শিল্পখাতও হুমকির মুখে পড়তে পারে। বিজিএমইএর তথ্য বলছে, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৮২টি পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, চাকরি হারিয়েছেন প্রায় এক লাখ ৯ হাজার ২৭৫ শ্রমিক। একই সময়ে নতুন ১৬৫টি কারখানা সদস্যপদ পেয়েছে, যেখানে কর্মসংস্থান হয়েছে ৯৭ হাজার ৮৬৬ জনের। ফলে এক বছরেরও বেশি সময়ে ১৭টি কারখানা কমেছে এবং ১১ হাজার ৪০৯ শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। শিল্প পুলিশের তথ্যে আরও ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে—তারা জানিয়েছে, গত এক বছরে মোট ২৫৮টি কারখানা স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়েছে, যার মধ্যে ৫৭টি কারখানা বিশেষভাবে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বন্ধ হয়েছে। কারখানা বন্ধের কারণ হিসেবে উঠে এসেছে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, মালিকদের বিদেশে অবস্থান, ব্যাংকঋণের জটিলতা, বৈদেশিক ক্রেতার কার্যাদেশ সংকট, এলসি সমস্যা এবং শ্রমিক অসন্তোষ। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই বহুমাত্রিক সংকটের সমাধান ছাড়া শিল্প খাতের স্থিতি নিশ্চিত করা কঠিন। তবে সংকটের মধ্যেও আশার কথা শোনা যাচ্ছে নতুন কারখানা চালুর খবরে। শিল্প পুলিশ সূত্রে জানা যায়, গত এক বছরে দেশে ২৬৫টি নতুন কারখানা চালু হয়েছে, যেখানে কাজ পেয়েছেন প্রায় ৬২ হাজার শ্রমিক। ডাইফির হিসাবে, ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় এক বছরে ৯৩৭টি নতুন কারখানা খোলা হয়েছে, যদিও একই সময়ে ২৪৫টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। অর্থাৎ, নতুন কর্মসংস্থান হলেও সেটা চাকরিহারা শ্রমিকদের তুলনায় এখনও কম। শ্রমিক অসন্তোষও ক্রমেই বাড়ছে। গত এক বছরে ১৩০টি কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দিয়েছে, এবং এখনো ৩৪টি কারখানায় অস্থিরতা অব্যাহত রয়েছে। মূলত মজুরিকাঠামো, বকেয়া বেতন, কর্মপরিবেশের মান এবং রাজনৈতিক প্রভাব এই অসন্তোষকে তীব্র করেছে। সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের সভাপতি রাজেকুজ্জামান রতন মনে করেন, খাতটি ৪০ বছর ধরে চললেও অস্থিরতা কাটেনি—এটি সত্যিই বিস্ময়কর। তার মতে, অতিরিক্ত রাজনৈতিকীকরণ, দুর্নীতি ও টাকাপাচারের সংস্কৃতি থেকে বের হতে না পারলে এ সংকট নিরসন সম্ভব নয়। শ্রমিকদের জন্য জরুরি তহবিল গঠন ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত শিল্পনীতি জরুরি বলেও তিনি মন্তব্য করেন। অর্থনৈতিক বিশ্লেষক মাশরুর রিয়াজ মনে করেন, পোশাক খাতে স্থায়ী অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, যার ফলে দুই শতাধিক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে এবং লক্ষাধিক শ্রমিক কর্মহীন। এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তার মতে, সরকারের উচিত সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে জরুরি সংলাপ ও কর্মহীন শ্রমিকদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা। সবশেষে, সংশ্লিষ্টদের মতে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, শ্রমিক স্বার্থ সংরক্ষণ এবং টেকসই শিল্পনীতি ছাড়া এ সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়। নতুন কারখানা চালুর প্রবণতা আশার আলো দেখালেও, টেকসই সমাধানের জন্য দরকার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। এই মুহূর্তে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে দেশের প্রধান রপ্তানি খাতের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ আরও বাড়বে, যা জাতীয় অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।