“কেউ জমি না দিলে ওই প্রতিষ্ঠান সরানো সম্ভব হবে না, সরকার জমি কিনে ভবন করবে না; এভাবেই প্রতিষ্ঠান চালাতে হবে,” বলেন ধুনট উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ফজলুল।
তিনবার যমুনা নদীতে বিলীন হওয়ার পর শিক্ষকরা নিজের গাঁটের পয়সায় মাত্র পাঁচ শতক জায়গা কিনে চতুর্থবারের মতো স্কুলটি চালু করেছিলেন। কিন্তু সেই স্কুলের শ্রেণিকক্ষের সঙ্গে দুটি বসতবাড়ির টয়লেট, বারান্দার সঙ্গে মুরগির খোপের গন্ধে টেকা দায় হলেও সেখানেই ক্লাস করছে শিক্ষার্থীরা।
এই অবস্থা বগুড়ার ধুনট উপজেলার ভান্ডারবাড়ী ইউনিয়নের যমুনা পাড়ের রাধানগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের। ১৯৯৪ সাল থেকে বিদ্যালয়টি তিনবার জায়গা পরিবর্তন করে এখন বালিয়া আটাপাড়া গ্রামে আছে।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, এখানে তাদের জন্য কোনো টয়লেট নেই। সড়ক দিয়ে বালুবাহী ট্রাক আর নদীতে বালি উত্তোলনকারী ড্রেজারের বিকট শব্দে তারা অতিষ্ঠ। স্কুলের বারান্দার সামনেই ইট আর বালুর স্তূপ। কোনোভাবেই ক্লাসে মনোযোগ দিতে পারে না।
শিক্ষকরা বলছেন, জায়গার অভাবে শিশুদের কোনো সমাবেশ এখানে হয় না। ৩০ বছর ধরে এখানে কোনোদিন জাতীয় সংগীতও গাওয়া হয়নি। এই অবস্থার মধ্যেই তাদের স্কুলটি পরিচালনা করতে হচ্ছে।
তবে বিদ্যালয়ের এই অবস্থার কথা জেনে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন খোদ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. রেজোয়ান আহাম্মদ।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কেন এতদিন বিদ্যালয়ের টয়লেটসহ অন্যান্য ব্যবস্থা হল না, এটা আমার মাথায় কাজ করে না। উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা কী করেন তাহলে?
“সরকার প্রাথমিক শিক্ষায় কোটি কোটি টাকা ব্যয় করছে। অথচ রাধানগর স্কুলটির অবস্থা এমন! দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করব এ স্কুল নিয়ে।”
স্কুলের শিক্ষকরা জানান, ১৯৭৩ সালে ভান্ডারবাড়ী ইউনিয়নের রাধানগর গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়। তারপর যমুনার ভাঙনে রাধানগর গ্রামটি বিলীন হয়ে যায়। তখন বিদ্যালয়টি ইউনিয়নের চৌবের গ্রামে স্থানান্তর করা হয়।
এক সময় চৌবের গ্রামও যমুনায় বিলীন হয়ে যায়। তখন বিদ্যালয়টি স্থানান্তর করে নিয়ে আসা হয় শহড়াবাড়ী গ্রামে। শহড়াবাড়ীও এক পর্যায়ে যমুনা গর্ভে চলে যায়। অবশেষে বিদ্যালয়টি নিয়ে আসা হয় বালিয়া আটা গ্রামে।
তবে বিদ্যালয়টির নাম কখনো পরিবর্তন করা হয়নি। এখনো সেটি রাজানগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় হিসেবেই আছে। তিনজন পুরুষ ও দুইজন নারী শিক্ষক দিয়ে পরিচালিত বিদ্যালয়টির শিক্ষার্থী সংখ্যা ৬৯।
সম্প্রতি গিয়ে দেখা যায়, সড়ক লাগোয়া একটি জনবসতির মধ্যে বিদ্যালয়টি অবস্থান। দেখলে মনে হবে- কারো বাড়ি হয়তো! টিন শেডের পাঁচটি কক্ষ। একটিতে শিক্ষকরা বসেন। বাকি কক্ষের মধ্যে দুটিতে শিক্ষার্থীদের বসার ব্যবস্থা থাকলেও অন্য দুটি একেবারেই পরিবেশ সম্মত না।
বিদ্যালয় ঘেঁষেই হায়দার আলী ও তোতা মিয়ার বসতবাড়ি। দুটি শ্রেণিকক্ষের পাশেই ওই বাড়ির দুটি টয়লেট। সেই টয়লেট থেকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। প্রতিষ্ঠানের বারান্দা ঘেঁষে মুরগির খোপ। পাশেই আবর্জনার স্তূপ। সেখান থেকেও বিকট গন্ধ আসছে।
পাঁচ শতক জায়গার অধিকাংশ জুড়েই বিদ্যালয়ের কক্ষ। সামনে এক চিলতে ফাঁকা জায়গা। সেখানেও রাখা আছে ইটের স্তূপ। বিদ্যালয়ের একপাশে স্কুলের দুটি টয়লেট থাকলেও তা ব্যবহারের অনুপযোগী।
বিদ্যালয় লাগোয়া সড়ক দিয়ে অনবরত বালুর ট্রাক যাচ্ছে। তার শব্দ আসছে এখানে। এই বিদ্যালয় থেকে ২০০ গজ দূরে শহড়াবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, আধা কিলোমিটার দূরে চুনিয়াপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং পৌনে এক কিলোমিটার দূরে আটাচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ওই তিনটি স্কুলই পরিপাটি।
কিন্তু রাধানগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টির অবস্থা সবচেয়ে নাজুক। সেখানে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে শিশুদের শিক্ষা কার্যক্রম চলছে।
শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা জানায়, খোলা জায়গা না থাকায় তাদের কোনো সমাবেশ হয় না। সবচেয়ে কষ্টকর বিষয় হচ্ছে, নারী শিক্ষক ও মেয়েশিশুদের মানুষের বাড়ি এবং পুরুষ শিক্ষকদের পাশের মসজিদে গিয়ে টয়লেট সারতে হয়।
বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী লামিয়া আখতার বলল, “টয়লেট নেই আমাদের। অন্যের বাড়িতে গেলে বিরক্ত হয়। বলে, ‘আর আসবি না’। একটা টয়লেট খুবই প্রয়োজন আমাদের।
“স্যারদের বললে উনারা বলেন, ‘অফিসে বলেছি, হয়ে যাবে’। এটা তো জরুরি প্রয়োজন।”
লামিয়া বলে, “এ ছাড়া স্কুল চলার সময় বালির ট্রাক যাতায়াত করায় শব্দে স্যারদের পড়া শুনতে সমস্যা হয়। বালি এসে চোখে-মুখে লাগে, শ্বাস নিতে কষ্ট হয়।”
একই ক্লাসের রিয়াদ হাসান বলে, “অন্য স্কুলে খেলার মাঠ আছে, আমাদের এখানে নেই। টিফিন হলে পাশের মাঠে খেলতে যেতাম। কিন্তু যমুনা থেকে বালি উঠিয়ে সেখানে রাখায় সেই খেলাও বন্ধ হয়ে গেছে।
“ভর্তির পর থেকেই বিদ্যালয়ের জায়গা না থাকায় অন্য স্কুলের মত সমাবেশ, শপথ পাঠ, জাতীয় সংগীতও গাওয়া হয় না। অন্যদের কাছ থেকে শিখেছিলাম। এখন প্রায় ভুলেই গেছি।”
চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র আল ইমরান বলে, “পাশের দুটি বাড়ির টয়লেট থেকে দুর্গন্ধ ছড়ায়। খুবই খারাপ লাগে। স্কুলের মাঝে অন্যের বাড়ি।
“তাই গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগির উৎপাত। বড় জায়গায় স্কুলটি নিয়ে যাওয়া দরকার।”
এসব বিষয় নিয়ে প্রধান শিক্ষক আকবর আলী বলছিলেন, তিনবার নদীতে বিলীন হওয়ার পর শিক্ষকরা টাকা দিয়ে এখানে পাঁচ শতক জায়গা কেনেন। পরে সেখানে সরকার থেকে সেমিপাকা একটি তিন কক্ষের ঘর করে দেয়। এরপর দুই লাখ টাকা অনুদান পেলে তার সঙ্গে শিক্ষকরা আরো কিছু টাকা দিয়ে একটা দুই কক্ষের টিনশেড ঘর করা হয়। সঙ্গে কিছু আসবাবপত্র কেনা হয়।
দুটি টয়লেট করা হলেও এখন অকেজো। প্রায় দুই বছর ধরে এমন অবস্থা। বালু ব্যবসায়ীদের ঘেরাটোপে পড়ে অবস্থা আরো খারাপ হয়েছে।
উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে বিষয়টি লিখিতভাবে জানানো হলেও কোনো সুরাহা হয়নি বলে জানান প্রধান শিক্ষক। তিনি স্বীকার করেন, জায়গার অভাবে কোনোদিন এখানে শিশুদের সমাবেশ বা জাতীয় সংগীত গাওয়া হয়ে ওঠেনি। কেউ বিদ্যালয় পরিদর্শনে এলে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়।
বলছিলেন, “বিদ্যালয়ের সামনে আবর্জনা, মুরগির খোপ। স্কুলের লাগোয়া জায়গা বাড়ির মালিকদের নিজস্ব। এমনকি স্কুলের বারান্দাও তাদের জায়গায়। তাই কিছু বলতে পারি না।
“বিদ্যালয়টি সরিয়ে বড় পরিসরে না নিলে শিশুদের জন্য এমন জায়গায় পাঠদান অসম্ভব। মনে হয়, বাংলাদেশের একমাত্র অবহেলিত বিদ্যালয় এটি।”
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ধুনট উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ফজলুল হক বলেন, “টয়লেট হয়ে যাবে এখন। বালু ব্যবসায়ীরা বালু উত্তোলনের সময় তাদের বালুর নিংড়ানো পানি এবং বালুতে টয়লেট দুটি নষ্ট হয়ে গেছে।
“তবে কেউ জমি না দিলে ওই প্রতিষ্ঠান সরানো সম্ভব হবে না। সরকার জমি কিনে ভবন করবে না। এভাবেই প্রতিষ্ঠান চালাতে হবে।”