পুরান ঢাকার সিংটোলা গলির মাথায়, এক পাঠশালার সীমানা পেরিয়ে, আমি সদ্য ভর্তি হলাম জুবিলী হাইস্কুলে। ৭৪ নম্বর ফরাশগঞ্জে আমাদের বাসা, যা পরবর্তীতে পুঁথিঘর লিমিটেডের ঠিকানা হয়ে ওঠে। ৭৪ নম্বরটি ছিল আমার বাবার, অজিতকুমার চক্রবর্তীর, কর্মস্থল—চিত্তরঞ্জন কটন মিলের প্রধান কার্যালয়। বিশাল জমিদারি ভবন, যেখানে আরও দুটি বড় দালান ছিল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসস্থল। বাবার অফিসে একটি ‘অফিসার্স রিক্রিয়েশন ক্লাব’ ছিল, যার অন্যতম আকর্ষণ ছিল একটি সমৃদ্ধ পাঠাগার।
সেই পাঠাগারে প্রথমবারের মতো সক্রেটিসের মুখোমুখি হই। একটি বুড়ো লোকের ছবি আঁকা মলাটে ‘খটমটে’ নামটি ছাপানো। প্রথম দেখায়, তাঁর প্রতি আমার আগ্রহ ছিল না। কিন্তু বাবার ঘরে আবার দেখা হলে, মনে হলো, নিশ্চয়ই তিনি গুরুত্বপূর্ণ কেউ। এরপর সক্রেটিসের চিন্তার জগতে প্রবেশ। আজ ভাবছি, আমার জীবনে কার ছায়া সবচেয়ে বেশি পড়েছে—সক্রেটিস, জমিদারি ভবনের সেই লাইব্রেরি, নাকি আমার স্কুলের বন্ধু খান মুহম্মদ শিহাবউদ্দিনের বাবা, কবি খান মুহম্মদ মঈনুদ্দীন (১৯০১-৮১)। শিহাবউদ্দিনের সুবাদে কাজী নজরুল ইসলামের এই বন্ধুর বাড়িতে আমার যাতায়াত ছিল। বাড়ির বইয়ের ঘরটিতে বসে কবি সারাক্ষণ কিছু না কিছু পড়তেন। বইয়ের সেই ঘর আমার কাছে দেবালয়ের মতো মনে হতো।
বাবা ও তাঁর সহকর্মীদের মধ্যে বই পড়ার প্রতিযোগিতা ছিল। আলোচনা হতো তুমুল। আমাদের বাড়িতে মা-বাবা এবং ঠাকুরমা—সবাই ছিলেন পড়ুয়া। ঠাকুরমার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না, তবে তিনি পড়তে ও লিখতে পারতেন। আশপাশের প্রায় সব বাসাতেই বই পড়ার রীতি ছিল। বই আনা-নেওয়া, আলোচনা—সবই চলত। আমাদের বাসায় তখন প্রায় শ খানেক বই ছিল। আমার মধ্যে বই পড়ার অভ্যাস সম্ভবত তখন থেকেই গড়ে উঠতে শুরু করে।
আমাদের বাসায় একটি বিশাল বাংলা অভিধান ছিল। সেখানে একটি শব্দের বিশ্লেষণ করা হয়েছিল ছড়া দিয়ে: ‘নামটি আমার গডাঢর, সবাই ডাকে গডা/ সারাটা ডিন রোডে টো টো গায়ে ঢুলো কাডা/ ডাডা বললেন গাঢা, টুই লিখবি পড়বি নে?/ অমনি আমি কেঁডে ডিলুম এঁ হেঁ হেঁ হেঁ হেঁ।’ ছেলেবেলায় এই গদাধরটির সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে দেখতাম। একটু বেশি অমনোযোগী ছিলাম বলে একজন গৃহশিক্ষকের তত্ত্বাবধানে আমাকে রাখা হয়েছিল। সকালে বাসায় এসে ঘুড়ি-নাটাইসহ কান ধরে তিনি আমাকে ছাদ থেকে নামিয়ে আনতেন। স্কুলের পাঠ্যবইয়ে বিতৃষ্ণা ছিল প্রবল, অথচ গল্পের বই নাওয়া-খাওয়া ভুলিয়ে দিত। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার প্রতি সেই অরুচি আজও কাটেনি।
বই কেনা, পাঠাগার পরিচালনা ইত্যাদির জন্য বাবার অফিসে একটি কমিটি ছিল। বই কেনার সময় বড়দের সঙ্গে অফিসের গাড়িতে চড়ে বাংলাবাজারের দোকানগুলোয় আমি অনেকবার গিয়েছি। একবার এ রকম যাত্রায় দোকানদারের কাছ থেকে একসঙ্গে ছবিওয়ালা নতুন দুটো গল্পের বই উপহার পেয়েছিলাম। একটি সৌরজগৎ বিষয়ক, অপরটি প্রাণিজগৎ নিয়ে।
স্কুলের কাছেই বাংলাবাজার। সেখানকার বিচিত্র সব বইয়ের প্রতি আমার ছিল লোলুপ নজর। দোকানে দোকানে ঘুরে নতুন বইয়ের ঘ্রাণে আমোদিত হতাম। কিনতে পারতাম না, তবে মাধ্যমিক শেষ করার আগেই টিউশনের টাকা জমিয়ে বই কেনা শুরু হয়। কাছেই বিখ্যাত বিউটি বোর্ডিং। নামজাদা লেখক-কবি-সাহিত্যিকদের জমজমাট আড্ডা। দূর থেকেই দেখতাম। বাবার অফিসের পাঠাগার থেকে তখন নিয়মিত বই এনে পড়া হতো। জন্মদিন কিংবা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অনেক বই উপহার হিসেবে পেতাম। নতুন বইয়ের