প্রায় এক বছর ধরে আলোচনা চলার পরও জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোনো ঐকমত্য গড়ে ওঠেনি। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সম্প্রতি অনুষ্ঠিত দীর্ঘ বৈঠকও শেষ হয়েছে সমাধানহীনভাবে। মূলত, সনদ বাস্তবায়নে গণভোটের সময় ও পদ্ধতি নিয়ে দলগুলোর মতবিরোধ থেকেই যাচ্ছে। বিশেষ করে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)– এ তিন দলের অনড় অবস্থান পুরো প্রক্রিয়াকে জটিল করে তুলেছে। কমিশন জানিয়েছে, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ ও রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত সমন্বয় করে তারা খুব শিগগিরই সরকারের কাছে সুপারিশ পেশ করবে। ১৫ থেকে ১৭ অক্টোবরের মধ্যে জুলাই সনদে স্বাক্ষরের আশা প্রকাশ করলেও, বাস্তবতা বলছে, মতবিরোধের জট কাটছে না। শেষ দিনের আলোচনায় দলগুলো দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে—একপক্ষ জাতীয় নির্বাচনের দিনেই গণভোট চায়, অন্যপক্ষ জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোটের পক্ষে। গণভোটের প্রশ্নবিধি নিয়েও একমত হওয়া যায়নি। ফলে চূড়ান্ত খসড়া তৈরি হলেও, বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে অচলাবস্থা থেকেই যাচ্ছে। এ অবস্থায় জাতীয় নির্বাচন অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। যদিও আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে ভোটের সময় নির্ধারিত রয়েছে, সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং আইনশৃঙ্খলার অবনতিতে নির্বাচন ঘিরে অনিশ্চয়তা বাড়ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে ফের অস্থিরতা, এনসিপির প্রতীক জটিলতা, আইনশৃঙ্খলার অবনতি এবং আন্তর্জাতিক প্রবৃদ্ধি—সব মিলিয়ে নির্বাচন সামনে রেখে সংশয়ের আবহ তৈরি হয়েছে। প্রশাসনও চরম অনিশ্চয়তায় দিন পার করছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সচিববিহীন, মাঠ প্রশাসনের প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি এখনও শুরু হয়নি, নির্বাচনের বাকি মাত্র চার মাস। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাতিসংঘ অংশগ্রহণমূলক ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনকে টেকসই গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তবে ‘অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন’-এর ব্যাখ্যা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে বিতর্ক তীব্রতর। নিষিদ্ধ দলকে পুনর্বাসনের ষড়যন্ত্র চলছে—এমন আশঙ্কাও প্রকাশ পেয়েছে। সম্প্রতি নরডিক রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে নিষিদ্ধ দলের নেতার বৈঠক ঘিরে রাজনীতিতে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। জুলাই আন্দোলনের শক্তিগুলোও এখন একে অপরের বিরুদ্ধে সমালোচনায় মুখর। এনসিপি তাদের অবস্থান ঘন ঘন বদলাচ্ছে, প্রতীক জটিলতাও কাটছে না। আইনশৃঙ্খলার অবনতির ধারাবাহিকতায় বেড়েছে চুরি, ছিনতাই, হত্যা ও সংঘর্ষের ঘটনা। নিরাপত্তা নিয়ে জনগণের উদ্বেগ বাড়ছে, প্রশাসনও নড়বড়ে। পার্বত্য চট্টগ্রামে নতুন সশস্ত্র গোষ্ঠীর উত্থান, সীমান্ত উত্তেজনা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে। নির্বাচনের আগে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা পুরো দেশকে প্রভাবিত করতে পারে। সব মিলিয়ে জাতীয় নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক সংকট ও অনিশ্চয়তা চরমে পৌঁছেছে। দেশের মানুষ এখনো উৎসবমুখর নির্বাচনের অপেক্ষায়। একটি নির্বাচিত সরকারই পারে এই অচলাবস্থার অবসান ঘটাতে। অতীতে সংকট কাটিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার নজির রয়েছে; এবারও সেই পথ খোলা আছে, যদি রাজনৈতিক দলগুলো সংলাপ ও সমঝোতার পথে ফিরে আসে। অন্যথায়, ফেব্রুয়ারির নির্বাচন শুধু অনিশ্চিতই নয়, বরং জাতীয় স্থিতিশীলতাকেও হুমকির মুখে ফেলতে পারে।